‘হিন্দু মহাসভা’ প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করো।
![]() |
| হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা করো। |
১৯১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের হরিদ্বারে কুম্ভমেলা চলাকালে মদনমোহন মালব্যের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা’ যা সংক্ষেপে ‘হিন্দু মহাসভা’ নামে পরিচিত। মুসলিম লীগের মতো হিন্দু মহাসভাও ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার পটভূমি :
ভারতে হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু সম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও প্রসারের পিছনে যে সমস্ত ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা হল—
১) সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের ইতিহাস বিকৃতি :
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ভ্রান্ত ইতিহাস চেতনার জন্ম দেয় এবং ভারতের ইতিহাসকে সচেতন ভাবে বিকৃত করে। উদ্দেশ্য ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা।
- ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের ভূমিকা : ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ— হিসেবে ভাগ করেন এবং ব্রিটিশ শাসনের সুবিধার্থে মধ্যযুগে হিন্দুদের উপর মুসলমান শাসকদের অত্যাচারের বিকৃত ইতিহাস রচনা করেন।
- মুসলমান বিরোধী প্রচারাভিযান : ১৮৭০ এর দশকে এই বিকৃত ইতিহাসের প্রভাবে এবং নিজেদের শ্রেণিগত স্বার্থে হিন্দু জমিদার, মহাজন, ব্যবসায়ী ও ব্রিটিশ সরকারের কিছু ভারতীয় কর্মচারী হিন্দুত্ববাদী সংগঠন গঠন করে মুসলমান বিরোধী প্রচার অভিযানে লিপ্ত হয়। এরা সুলতানি ও মুঘল শাসকদের অত্যাচারী এবং ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংসকারী হিসেবে হিন্দু সমাজের কাছে তুলে ধরে।
স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ হিন্দু জনমানসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ভীষণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
২) ভাষা বিষয়ক বিতর্ক :
এই সময় থেকেই উত্তর প্রদেশ ও বিহারে এই ধরণের সংগঠনগুলি হিন্দি ভাষাকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক প্রচার শুরু করে। এরা প্রচার করে হিন্দি হল হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু মুসলমানদের ভাষা। এই বিতর্ক উত্তর ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটায়।
[যদিও এই দাবিটি সম্পূর্ণ অনৈতিহাসিক। কারণ, হিন্দি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ভাষা আর উর্দু ও সংস্কৃত ছিল যথাক্রমে মুসলিম ও হিন্দু উচ্চবর্গের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ভাষা। দুটি ভাষারই জন্ম মধ্যযুগে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়।]
৩) গোহত্যা বিরোধী আন্দোলন :
প্রাচীন যুগে নয়, মধ্যযুগে গরু ভারতীয় হিন্দু সমাজে পবিত্রতা ও দেবত্বের প্রতীক্ষ হয়ে ওঠে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি মুসলমানদের ঈদের সময় গরু জবাই করার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম ভারত সহ রোহিলা খন্ড অযোধ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে।
[লক্ষণীয় বিষয় হল, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য নির্বিচারে গোহত্যা হলেও এই আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়, শুধুমাত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ ধারণ করে।]
৪) আর্য সমাজের ভূমিকা :
আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ‘শুদ্ধি আন্দোলনে’র মাধ্যমে হিন্দুদের হিত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
- ধর্মত্যাগী হিন্দুদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
- ১৮৮২ সালে ‘গো-রক্ষিণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করে গো-হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
- এবং ‘গো-করুণানিধি’ গ্রন্থের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে অত্যন্ত আক্রমাত্মক করে তোলেন।
৫) সহবাস সম্মতি বিল ও তার প্রতিক্রিয়া :
১৮৯১ সালে বড়লাট ল্যান্স ডাউন ‘সহবাস সম্মতি বিল’ পাস করেন। এই বিলের মাধ্যমে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১০ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হয়। প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠাতা মহাদেব গোবিন্দ রানাডে এই আইনকে সমর্থন করলেও কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতা বালগঙ্গাধার তিলক এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং প্রচার করেন এই আইনের মাধ্যমে সরকার হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।
৬) সরকারের মুসলিম তোষণ নীতি :
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে আসছিল। অন্যদিকে মুসলিমদের সঙ্গে ছিল বৈরিতার সম্পর্ক। কিন্তু ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর পরিস্থিতি উল্টো খাতে বইতে শুরু করে। স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে থাকে। হিন্দুত্ববাদীরা এই ঘটনাকে মুসলিম তোষণ নীতি বলে আখ্যায়িত করেন। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মুসলিম-ভীতি তৈরি হয়।
৭) জাতীয় কংগ্রেসের ব্যর্থতা :
জাতীয় কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপর হিন্দুত্ববাদী নেতারা আস্থা রাখতে পারেননি। ‘মর্লে মিন্টো সংস্কার আইনে’র মাধ্যমে আইনসভার নির্বাচনে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে সরকারের মুসলিম তোষণ নীতি আটকানোর ক্ষেত্রে কংগ্রেসের দুর্বলতা প্রকাশ পায় বলে অভিযোগ করেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা।
৮) চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের প্রসার :
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনকে অভিন্ন বলে প্রচার শুরু করে। বালগঙ্গাধর তিলকের গণপতি উৎসব, শিবাজী উৎসব ইত্যাদির প্রচলন এবং বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়, অরবিন্দ ঘোষ প্রমূখ রাজনীতিকদের বক্তৃতার মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী সংগ্রামী মনোভাব জেগে ওঠে।
৯) বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের প্রভাব :
১৯০১ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘হিন্দু সম্মেলন’, ১৯০২ সালে মথুরায় গড়ে ওঠা ‘ভারত ধর্ম মহামন্ডল’, ‘শুদ্ধি সভা’, ‘সনাতন ধর্মসভা’ সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘হিন্দ-হিন্দি-হিন্দু’র আদর্শ প্রচার করে হিন্দু সম্প্রদায়িকতাকে আরও গভীরে প্রোথিত করেন। এই সময়ে ভারত ধর্ম মহামন্ডলের অধীনে সারা ভারত জুড়ে প্রায় ৬০০টি শাখা সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়।
১০) পাঞ্জাব হিন্দুসভার প্রভাব :
১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পাঞ্জাব হিন্দুসভা’। ১৯০৯ সালে পাঞ্জাব প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে লালা লাজপত রায় বলেন, “There can be no doubt that Hindus are a nation in themselves, because they represented type of civilization of their own.” এই সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা লালচাঁদ স্পষ্ট ভাষায় দাবি করেন, বর্তমানে হিন্দুদের উচিত কংগ্রেস ত্যাগ করা এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা।” এই সভায় তিনি স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেন, “আমি প্রথমে একজন হিন্দু, তারপর ভারতীয়।”
১৯০৯ সালে পাঞ্জাব হিন্দু সভার আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গোপালকৃষ্ণ গোখলে লেখেন, “এই আন্দোলন খোলাখুল মুসলমান বিরোধী, যেমন মুসলিম লীগ খোলাখুলি হিন্দু বিরোধী এবং উভয়ই জাতীয়তাবাদ বিরোধী।”
উপসংহার :
এইভাবে ১৮৫৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মুসলিমবিরোধী ও কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান এবং প্রচার হিন্দু মহাসভা গড়ে ওঠার পটভূমি তৈরি করে। ১৯১০ সালের ডিসেম্বর মাসে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভা’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শেষমেষ ১৯১৫ সালে হরিদ্বারে কুম্ভ মেলার সময় ‘পাঞ্জাব হিন্দুসভা’র উদ্যোগে, মদনমোহন মালব্যের নেতৃত্বে ‘সারা ভারত হিন্দু মহাসভা’ বা ‘হিন্দু মহাসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
------------xx-----------
🔯 [তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে থাকা অংশগুলো ঐচ্ছিক। উত্তর লেখার সময় পরীক্ষার খাতায় এই অংশগুলি ইচ্ছা করলে বাদ দিতেও পারো]
🔯 [মনে রাখতে হবে :
- ১) মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভা উভয় সংগঠনই উচ্চবর্ণের এবং উচ্চবর্গের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ হিন্দু এবং মুসলিম মানুষের কোন স্বার্থই এরা তাদের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেনি।
- ২) ধর্মকে এই দুই সম্প্রদায়ের অল্প সংখ্যক মানুষ তাদের শ্রেণিগত স্বার্থের কাজে ব্যবহার করেছেন ধর্ম রক্ষার অজুহাতে।
- ৩) এই দুই সম্প্রদায়ের অল্প সংখ্যক উচ্চবর্গের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষ। দেশভাগের কারণে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ অসহায় ভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন।]
এই প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- হিন্দু সম্প্রদায়িকতাবাদের পটভূমি ব্যাখ্যা করো।
- কে কী উদ্দেশ্যে হিন্দু মহাসভা গড়ে তোলেন? হিন্দু মহাসভা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করো।
- হিন্দু মহাসভা কী? হিন্দু মহাসভা গড়ে ওঠার কারণ কি ছিল?
- বিংশ শতাব্দীতে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি গড়ে ওঠার পটভূমি ব্যাখ্যা করো।
- অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা গড়ে ওঠার সম্ভাব্য কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।
- কত সালে অখিল ভারত হিন্দু মহাসভা গড়ে ওঠে? এই সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে কোন্ কোন্ ঘটনাবলী সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল?

.png)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন