জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা কী ছিল?
![]() |
| জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা কী ছিল? |
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাইতে ৭২ জন জনপ্রতিনিধি নিয়ে সংঘটিত একটি অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় । কংগ্রেসের উৎপত্তি ও তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে মতপার্থক্য থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে এ ব্যাপারে হিউম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা :
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব’ এবং দ্বিতীয়টি ‘হিউম-ড্যাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’।
ক) সেফটি ভালভ তত্ত্ব :
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় সেফটি ভালভ তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় দুটি সূত্র থেকে।
১) উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন ও সেফটি ভালভ তত্ত্ব :
হিউমের জীবনী গ্রন্থের লেখক উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন ‘সেফটি ভালভ তত্ত্বে’র প্রবক্তা। তিনি এই জীবনে গ্রন্থে (Alan Octavian Hume : father of Indian National Congress) লিখেছেন, “হিউমী ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের পরিকল্পনাকারী ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।”উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন-এর মতে, সরকারি দমননীতির ফলে সমগ্র ভারতে বিশেষ করে নিম্নশ্রেণির মানুষেরা যেকোনো সময় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে —স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কাছে আসা গোপন রিপোর্ট থেকে হিউম এমন আশঙ্কার কথা জানতে পারেন। উপলব্ধি করেন, এরফলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন আদায় এবং তাদের দিয়ে জনসাধারণের ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব দূর করার লক্ষ্য নিয়ে এলেন অক্টোভিয়ান হিউম কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। উইলিয়াম ওয়েডার বার্ন-এর লেখা এই ব্যাখ্যা ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব’ নামে পরিচিত।
২) উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেফটি ভাল্ব তত্ত্ব :
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গ্রন্থ (Introduction to Indian Politics) থেকে হিউম ও ড্যাফরিনের মধ্যে একটি সাক্ষাৎকারের কথা জানা যায়। ১৮৮৪ সালে সিমলা শহরে সংঘটিত এই সাক্ষাৎকারে হিউম বড়লাট জাফরিনের কাছে তাঁর কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা জানালে বড়লাট তাতে সম্মতি জানান এবং কিছু পরামর্শ প্রদান করেন। উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, লট ডাফরিন তাঁর পরামর্শে উল্লেখ করেন, “সরকারের কাজের ত্রুটি বিচ্যুতি সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত, শিক্ষিত ভারতবাসীর অভিমত জানতে পারলে তার কাজের সুবিধা হবে। সরকারকে মৃদু ধরনের সমালোচনা করার অধিকার পেলে ভারতীয় নেতারা সন্তুষ্ট থাকবেন। জাতীয় কংগ্রেস একটি ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে কাজ করবে।”
খ) হিউম-ড্যাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব :
এই তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত। একথা অনস্বীকার্য যে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক (অস্ত্র আইন, মাতৃভাষায় সংবাদপত্র আইন, ইলবার্ট বিল, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা) কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, দাক্ষিণ ভারতসহ বাংলা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক অশান্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে সারা ভারতে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে, রজনী পাম দত্তের মতে, “দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় যাতে কৃষকদের সঙ্গে মিলে কোন গণবিদ্রোহ সৃষ্টি না করেন সে কথা মাথায় রেখেই হিউম জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।”
ঐতিহাসিক রজনীপম দত্তের এই ব্যাখ্যা ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। রজনীপাম দত্তের কথায়, “বড়লাট লর্ড ডাফরিন ও অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস হিউমের মধ্যে এক গোপন চক্রান্তের ফলেই কংগ্রেস স্থাপিত হয়। এই দুই ব্রিটিশ রাজপুরুষ ভারতীয় জনগণের অসন্তোষের বাষ্পকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বারা গঠিত কংগ্রেসের মাধ্যমে নিরাপদে নির্গত করার জন্য ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে ‘কংগ্রেস’ স্থাপন করেন।”
হিউমের ভূমিকার সমালোচনা :
তবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে হিউমের ভূমিকার দাবিকে অনেক ঐতিহাসিক অতিরঞ্জন বলে দাবি করেছেন।
ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড. এস আর মেহেরোত্রা-সহ অনেক ঐতিহাসিক হিউমের ভূমিকাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন।
- ড. সুমিত সরকারের মতে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হিউমের ভূমিকাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
- এবিষয়ে ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর ভাবনা হল, “তখন ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল, তাতে হিউম না থাকলেও কোনো-না-কোনো সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হত।” এক্ষেত্রে তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জাতীয় সম্মেলন (১৮৮৩) আহ্বানের প্রতি আলোকপাত করেছেন।
- ড. অনিল শীলের মতে, “জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা কোন আকস্মিক, চমকপ্রদ, অলৌকিক ঘটনা নয়। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ক্ষেত্র কিছুকাল ধরে প্রস্তুত হয়েছিল।
অন্যদিকে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে মনে করতেন, “যেকোনো ভারতীয়ের পক্ষে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না।... কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা যদি একজন বিখ্যাত এবং সম্ভ্রান্ত প্রাক্তন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী না হতেন, তাহলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে যে কোন উপায়ে এই উদ্যোগ দমন করতেন।”
সুতরাং এ কথা বলা যায়, একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ চলছিল অনেক আগে থেকেই। হিউমের উদ্যোগে এই কাজটি ত্বরান্বিত হয় মাত্র। ড. বিপান চন্দ্রের ভাষায়, “১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কোন আকস্মিক ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা ছিল না। এটি একটি রাজনৈতিক জাগরণের পরিণতি।” আর হিউমের উদ্দেশ্য ছিলো, ভারতীয়দের মতামত তুলে ধরার জন্য এবং বিরোধীপক্ষ হিসেবে সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য ভারতে একটি সর্বভারতীয় সংস্থা গড়ে উঠুক, যেখানে উদারপন্থী রাজনীতিক হিসাবে তাঁর নিজের অংশগ্রহণ থাকবে।
------------xx-----------
এই প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- অ্যালেন অক্টোভিয়ান হিউম কে ছিলেন? জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ব্যাখ্যা করো।
- হিউমকে কী ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জনক’ বলা যায়? যুক্তি দেখাও।
- ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব’ ও ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলতে কী বোঝো? জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় এই তত্ত্বের গুরুত্ব কতটা?
- জাতীয় কংগ্রেস গড়ে তোলায় হিউমের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল?
এই বিভাগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করো।
- নরমপন্থী আন্দোলনের দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো।
- নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
- ‘ড্রেন অফ ওয়েলথ’ তত্ত্ব কী?

.png)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন