আলিগড় আন্দোলনে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের ভূমিকা
![]() |
| আলীগড় আন্দোলনে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের ভূমিকা |
আলিগড় আন্দোলন কী?
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ছিলেন মূলত একজন সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারক। উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজকে কুসংস্কার ও অশিক্ষা থেকে মুক্ত করা এবং সেই লক্ষ্যে সমাজে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। এছাড়া আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন সম্পর্কে মুসলিম সমাজকে সচেতন করে তোলা। মূলত এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি যে শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা আলিগড় আন্দোলন নামে পরিচিত।
আলিগড় আন্দোলনে সৈয়দ আহমেদের ভূমিকা :
১৮৬৯ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত সৈয়দ আহমেদ খান ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ কালে তিনি উপলব্ধি করেন পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার গুরুত্বের কথা। উপলব্ধি করেন মুসলিম সমাজের মধ্যে থাকা কুসংস্কার ও অজ্ঞতা দূর করতে না পারলে মুসলিম সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
১) ধর্ম সংস্কার ও সৈয়দ আহমেদ খান :
কিন্তু সমাজ সংস্কারের আগে দরকার ছিল সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় চিন্তাভাবনার পরিবর্তন। কারণ ধর্মীয় আদর্শ ও রীতিনীতি সমাজকে গভীরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে। সে কারণে প্রথমেই তিনি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে হাত দেন।
এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি কোরআনের উপর একটি ভাষ্য রচনা করেন এবং বলেন কোরআনই একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ যেখানে বর্ণিত আদর্শই মুসলমানদের একমাত্র পালনীয়। কোরআনের এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে মুসলিম সমাজের মধ্যে থাকা গোড়ামী ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন।
২) সমাজ সংস্কার ও সৈয়দ আহমেদ খান :
ধর্মীয় সংস্কারের সূত্র ধরেই শুরু হয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন। রাজা রামমোহন রায় ও ইয়ং বেঙ্গল দলের মতো করে তিনি সমাজের রক্ষণশীলতা দূর করার চেষ্টা করেন। সমাজে প্রচলিত পর্দা প্রথা, তালাক প্রথা, পুরুষদের বহুবিবাহ, পীর মুরিদি প্রথার নিন্দা করেন। নারী শিক্ষার পক্ষে প্রচার শুরু করেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, নারী জাতির মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ না করলে মুসলিম সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
শেখ চিরাগ আলি, আলতাব হোসেন আলী, মৌলানা শিবলী নোমানি, নাজির আহমেদ প্রমূখ সহকর্মী ও সহযোগীদের মাধ্যমে তিনি এই সংস্কার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান।
৩) শিক্ষা সংস্কার ও সৈয়দ আহমেদ খান :
সৈয়দ আহমেদ উপলব্ধি করেছিলেন, ধর্ম এবং সমাজ সংস্কারকে এগিয়ে নিতে হলে মুসলিম সমাজের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রসার ঘটানো দরকার। মূলত এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি একের পর এক স্কুল কলেজ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্যোগেই একে একে গড়ে ওঠে গুলশান স্কুল (১৮৫৯), ভিক্টোরিয়া স্কুল (১৮৬২), মাদ্রাসাতুল উলুম মুসলমান-এ-হিন্দ (১৮৭৫), মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ বা আলিগড় কলেজ (১৮৭৭) ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মনে রাখা দরকার, তাঁর মৃত্যুর (১৮৯৪) পর এই কলেজে ১৯২০ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি লাভ করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার আলোয় আনা মূল লক্ষ্য হলেও আলিগড় কলেজে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে সব সম্প্রদায়ের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল। এমনকি সংস্কৃত পড়ানোর ব্যবস্থাও ছিল এই কলেজে।
৪) আধুনিকীকরণ ও সৈয়দ আহমেদ খান:
এ সমস্ত স্কুল এবং কলেজের মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজকে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করেন। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি গড়ে তোলেন—
- ট্রান্সলেশন সোসাইটি (১৮৬৪) : যা পরবর্তীকালে সাইন্টিফিক সোসাইটি নামে পরিচিতি পায়। এই সোসাইটির প্রধান কাজ ছিল বিজ্ঞান বিষয়ক ইংরেজি গ্রন্থের উর্দু ভাষায় অনুবাদ করা।
- বিহার সাইন্টিফিক সোসাইটি (১৮৬৪) : এই সোসাইটি ১৮৯৯ সালে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে লাঙ্গত সিং কলেজ নামে পরিচিত। এছাড়া এখান থেকে আখ্বারুল আখিয়ার নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশিত হতো।
- আঞ্জুমান-ই-আল-ফারজ (১৮৮৯) : এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৈয়দ আহমেদ কলেজের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
- আঞ্জুমান-ই-তারাক্কি-ই-উর্দু (১৯০৩) : উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
৫) রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ও সৈয়দ আহমেদ খান :
ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষেও স্যার সৈয়দ আহমেদ খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
ক) রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা :
এই উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন।
- মহামেডান এডুকেশনাল কংগ্রেস (১৮৮৬) : এর কাজ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদের সংগঠিত করা।
- ইউনাইটেড পেট্রিওটিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮৮৮) : এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সরকারের মুসলিমদের অংশগ্রহণে পথ উন্মুক্ত করা।
- উর্দু ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন (১৮৯০) ও মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন (১৮৯৩) : মূলত ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলিমদের রাজনৈতিক স্বার্থ তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
খ) রাজনৈতিক দর্শন :
স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ছিলেন উদারপন্থী ও যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনার অধিকারী। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল সমন্বয়বাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। সৈয়দ আহমেদ খান মনে করতেন, “হিন্দু মুসলমান একই মায়ের দুই সন্তান। ভারতমাতার দুই চোখ হল হিন্দু ও মুসলমান। এর একটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে অন্যটি রোগ ক্ষতি হবে।”
গ) রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন :
কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। মূলত
- ১৮৭০ এর দশকে পাঞ্জাব উত্তর-পশ্চিম ভারতসহ রোহিলা খন্ড অযোধ্যা প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি সংহত রূপ ধারণ করলে এবং ১৮৭৫ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সর্বভারতীয় চেহারা লাভ করলে। কারণ, এই আন্দোলনগুলো তো গড়ে উঠেছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে; ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নয়। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলন এক সাম্প্রদায়িক রূপ ধারণ করে।
- এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ট থিওডোর বেক সার সৈয়দ আহমেদ খানকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, “ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং শিক্ষায় অগ্রসর হিন্দুরাই শাসন ক্ষমতা হস্তগত করবে এবং মুসলিম সম্প্রদায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এ পরিণত হবে।”
সৈয়দ আহমেদ খানের ভূমিকার মূল্যায়ন :
মূলত, মুসলিম সমাজের অনগ্রসরতা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান তাঁর সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন।
সমালোচনা :
- তবে, অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, শ্রেণিভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই আন্দোলন সমগ্র মুসলিম জনগণকে স্পর্শ করেনি। তা ছিল মূলত উচ্চবৃত্ত মানুষের দ্বারা পরিচালিত।
- অন্যদিকে, ফ্রান্সিস রবিনসন, ডেভিড লেলিভেল্ট প্রমুখ ও সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক তাঁকে ‘দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম প্রবর্তক’ বলে অভিহিত করেছেন।
গুরুত্ব :
- কিন্তু অনেক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক এই মতের সঙ্গে একমত নয়। ডঃ শচীন সেন বলেছেন, “সৈয়দ আহমেদ হিন্দু বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন মুসলিমদের পক্ষে এবং কংগ্রেস বিরোধী।”
- বস্তুত, হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলমান সমাজের জন্য তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “উনিশ শতকের নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল, আলীগড় আন্দোলন মুসলিমদের কাছে ছিল ঠিক একই।” আর এ কারণেই তাঁকে ভারতের ‘মুসলিম সমাজে নবজাগরণের অগ্রদূত’ বা ‘মুসলিম সমাজের রামমোহন’ বলে অভিহিত করা হয়।
------------xx-----------
প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- স্যার সৈয়দ আহমেদ খান কে ছিলেন? ভারতীয় মুসলিম সমাজের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান উল্লেখ করো।
- কাকে কেন ‘মুসলমান সমাজের নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়?
- ভারতীয় ‘মুসলিম সমাজের রামমোহন’ কাকে বলা হয়? শিক্ষা সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে তার ভূমিকা কেমন ছিল?
- আলীগড় আন্দোলন বলতে কী বোঝো? ভারতের ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিল?
- ভারতীয় মুসলিম সমাজের আধুনিকীকরণে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের অবদান কতটা?

.png)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন