বিভাজন ও শাসন নীতি কী? ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির জন্য ব্রিটিশ সরকার এই নীতি কোন প্রেক্ষাপটে কীভাবে কার্যকর করেছিল?
অথবা,
কীভাবে 'বিভেদ ও শাসন' নীতি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সরকার ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতাকে খর্ব করতে চেষ্টা করেছিল?
অথবা,
ভারতে 'বিভেদ ও শাসন' নীতিপ্রয়োগের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে এর চরিত্র (বৈশিষ্ট্য) ব্যাখ্যা কর।
অথবা,
'বিভাজন ও শাসন নীতি' বলতে কী বোঝ? ব্রিটিশরা কী কারণে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধির চেষ্টা করে?
উত্তর :
উত্তর :
বিভাজন ও শাসন নীতি' কী
জাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি দেশের জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করে সাম্রাজ্যবাদী শাসক তাদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশল গ্রহণ করে। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই নীতি বা কৌশল 'বিভাজন ও শাসন নীতি' নামে পরিচিত। ভারত শাসনে ব্রিটিশ সরকার এই নীতি গ্রহণ করেছিল।
বিভাজন ও শাসননীতির প্রেক্ষাপট
ভারতে এই নীতি প্রয়োগের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করলে এর চরিত্র (বৈশিষ্ট্য) স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১) মাউন্টস্টুয়ার্ট এলফিনস্টোনের পরামর্শ অনুযায়ী ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ধর্ম ও জাতি-ভিত্তিক বিভাজন ঘটিয়ে ভারত শাসনে একই নীতি গ্রহণ করেছিল।
২) মহাবিদ্রোহ ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে যে লড়াই করেছিল তা ব্রিটিশ সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল।
৩) জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ভব। ১৮৮৫ সালে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় মিলিতভাবে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করলে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয় চেতনা বৃদ্ধির আশঙ্খায় ব্রিটিশ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
৪) ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় আন্দোলনে এই সম্প্রদায় অগ্রণী ভূমিকা নিলে ব্রিটিশ সরকার ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ক্ষোভকে উস্কে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে।
বিভাজন নীতির বিভিন্ন পর্যায়
ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সরকার বিভাজন নীতিকে তিনটি পর্যায়ে কার্যকর করেছিল।
১) হিন্দু তোষণ (প্রথম পর্যায়)।
ব্রিটিশরা প্রথমে মুসলমানদের আধিপত্য ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করেছিল। তাই মুসলিমরা প্রথম থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী ছিল। এই পর্বে ব্রিটিশরা তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দেখায়। এপ্রসঙ্গে লর্ড এলেনবরার বক্তব্য উল্লেখ্য, 'মুসলিম জনসমাজ মৌলিকভাবে আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। তাই আমাদের আসল লক্ষ্য হবে হিন্দুদের সাথে যোগাযোগ বাড়ানো।
২) মুসলিম তোষণ (দ্বিতীয় পর্যায়)।
উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্তা স্যার উইলিয়াম লি-র মতে, ১৮৬৯ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শিক্ষা ও প্রশাসনে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেস থেকে হোমরুল লীগ সব ক্ষেত্রেই একই চিত্র চোখে পড়ে। আর এরাই তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্ররোচনা দিচ্ছে। তাই এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার হিন্দুদের দুর্বল করার জন্য মুসলিম তোষণ শুরু করে।
৩) নিম্নবর্ণের তোষণ (তৃতীয় পর্যায়)।
তৃতীয় পর্যায়ে সরকার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে তোষণ শুরু করে। এপ্রসঙ্গে জর্জ হ্যামিল্টন বড়লাট কার্জনকে লেখেন, 'আমরা যদি হিন্দুদের দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করতে পারি তবে আমাদের শক্তি আরও সুদৃঢ় হবে।'
বিভাজন নীতির প্ৰয়োগ।
এইভাবে ধর্ম, বর্ণ ও জাতিভিত্তিক বিভাজন ঘটিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য চেষ্টা করে ব্রিটিশরা। এক্ষেত্রে যে যে পদক্ষেপ তারা গ্রহণ করে তা হল -
১) আর্থিক সহায়তা ও চাকরি প্রদান।
সরকার ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে আর্থিক সহায়তা করে এবং শিক্ষা ও চাকরি নিয়োগের ব্যবস্থা করে।
২) মুসলিম তোষণ।
১৮৫৭ পূর্ববর্তী সময়ে মুসলিমরা ছিল ব্রিটিশের প্রধান শত্রু। মহাবিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে তারাই হয়ে গেল ব্রিটিশের পরম বন্ধ। প্রশাসনে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সচেতন করার নতুন সাম্রদায়িক বিভাজনের খেলা শুরু করলো তারা। থিওডোর বেক, মরিসনকে দিয়ে স্যার সৈয়দ আহম্মদকে সামনে রেখে তার সফল প্ৰয়োগ ঘটালো।
৩) অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি তোষণ।
মুসলিম সম্প্রদায়ের আনুগত্য পাওয়ার পর বৃটিশ সরকার অব্রাহ্মণ ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের তোষণ শুরু করে। ১৯২১ সালে মাদ্রাজ ও ১৯২৫ সালে বোম্বাইয়ে অনগ্রসরদের সংরক্ষণ চালু করে। কোন কোন ইতিহাসবিদ বলেছেন এক্ষেত্রে লক্ষ্য সাম্য প্ৰতিষ্ঠা হলেও ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক। ১৯২০ দশকে ড. আম্বেদকরের আন্দোলন ব্রিটিশের এই বিভাজন নীতি কার্ষকর করতে সাহায্য করেছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন।
মূল্যায়ন।
এইভাবে ব্রিটিশ সরকার সাম্রদায়িক বিভাজন নীতি প্ৰয়োগ করে এদেশে তাদের অনৈতিক শাসন কায়েম রাখার চেষ্টা করেছিল। পন্ডিত লালবাহাদুর শাস্ত্রী সরকারের এই বিভেদনীতকে 'ভারতের জাতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নির্লজ্জ ঘটনা' বলে অভিহিত করেছেন। মর্লে-মিন্টো সংস্কার দিয়ে যার সূচনা করেছিল ভারত বিভাজনের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশ থেকে ব্রিটিশ বিদায় নিলেও বিভেদনীতি বিদায় হয়নি।
--------------//----------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন