কংগ্রেসের নরমপন্থী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো।
![]() |
| কংগ্রেসের নরমপন্থী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা |
১৮৮৫ সালে ৭২ জন প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার (১৮৮৫) পর থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেস মূলত আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করে। দাবি-দাওয়া আদায়ের এই নরমপন্থার কারণে এই পর্বের (আদি জাতীয়তাবাদী) আন্দোলনকে ‘নরমপন্থী আন্দোলন’ বলে অভিহিত করা হয়।
নরমপন্থী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা :
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বিস্তারিত কংগ্রেসের কার্যাবলী বিশ্লেষণ করলে নরমপন্থী আন্দোলনের সীমাবদ্ধগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১) সাংগঠনিক দুর্বলতা :
জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বে তার সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল প্রকট। ড. সুমিত সরকারের মতে, এই পর্বে “কংগ্রেস কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এর স্থায়ী কর্মপরিষদও ছিল না। ফলে গণ-আন্দোলন সংঘটিত করা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল।”
২) নরমপন্থী নীতি :
নরমপন্থী পর্বের আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দূর্বলতা ছিল তার নরমপন্থী নীতি। আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে যে কোন দাবী-দাওয়া আদায় করা সম্ভব নয়, এটা তারা বোঝেননি।
৩) গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব :
কংগ্রেসের নরমপন্থী পর্বের নেতাদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও ছিল প্রকট। বোম্বাই, কলকাতা এবং মাদ্রাজের নেতাদের মধ্যে আধিপত্য লাভের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা কংগ্রেসকে দুর্বল করে দেয়।
৪) সংকীর্ণ সামাজিক ভিত্তি :
সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের ঠাঁই হয়নি কংগ্রেসের সংগঠনে। তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে মধ্যবিত্ত, নিম্মমধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গের মানুষের তেমন কোনো যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি।
৫) কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাব :
এই পর্বের আন্দোলনের তেমন কোন কৃষিভিত্তিক কর্মসূচি ছিল না, যা কৃষকদের সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন। ফলে এই আন্দোলনে কৃষকরা আগ্রহ দেখায়নি।
৬) মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতি :
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরাও এই আন্দোলনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি। হিউম মুসলিম ও কৃষক সমাজকে কংগ্রেসী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে নরমপন্থী নেতাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র মতভেদ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হিউম ১৮৯২ সালে কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৭) অভিজাত চরিত্র :
প্রথম পর্বের নেতারা ছিলেন মূলত অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ। জমিদার, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির এই নেতাদের জমিদারি সহ নিজেদের পেশাগত সুবিধা আদায় করাই ছিল একমাত্র মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ড. সুমিত সরকারের মতে, “সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে নিচু তলার মানুষ ছিল বিজাতীয়।”
৮) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সীমিত :
এইভাবে হাতে গোনা কিছু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে এই পর্বের আন্দোলন কোন বৃহত্তর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগোতে পারেনি। পূর্ণ স্বাধীনতা তো নয়ই, এমনকি স্বায়ত্তশাসনের মত আংশিক শাসনতান্ত্রিক অধিকারের দাবি করার মত লক্ষ্যও গ্রহণ করেনি।
৯) সরকারের উপর প্রগাঢ় বিশ্বাস :
নরমপন্থী নেতারা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশরা উদার এবং বিনয়ের সঙ্গে আবেদন নিবেদনের মাধ্যমেই তাঁরা তাঁদের সুযোগ সুবিধা আদায় করতে পারবেন। ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর কথায়, “ব্রিটিশ সরকারের কিছুটা উদারতা লাভ করে ধন্য হওয়াই ছিল নরমপন্থী নেতাদের প্রধান লক্ষ্য।”
১০) গণভিত্তির অভাব :
লালা লাজপত রায় এর মতে, কংগ্রেসের আন্দোলন ছিল ‘ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ এবং ‘সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় সংগঠিত হয়নি’ এমন এক আন্দোলন। তাই এই পর্বের আন্দোলনের গণভিত্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল।
নরমপন্থী আন্দোলনের মূল্যায়ন :
মূলত এই সমস্ত সীমাবদ্ধতার কারণে এই পর্বের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। তবে, এই আন্দোলন একেবারে গুরুত্বহীন ছিল না।
ইতিবাচক প্রভাব :
- নারম্পন্থী জাতীয়তাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রান্তরিক আন্দোলনের সূচনা করে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সর্বোপ উদঘাটন করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
- ড. বিপানচন্দ্রের মতে, “১৮৫৮ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত সময়কাল হল জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপনের যুগ। আদি জাতীয়তাবাদীরা সে ভিত্তি যত্ন সহকারেই স্থাপন করেছিলেন।”
নেতিবাচক প্রভাব :
- নরমপন্থীদের এই ব্যর্থতা যে হতাশার জন্ম দিয়েছিল, তা থেকে জন্ম নিয়েছিল চরমপন্থী আন্দোলনের।
- এবং এই চরমপন্থীরা হিন্দুধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখেছিলেন। ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছিল।
যাই হোক, তাদের বহু ব্যর্থতা সত্বেও জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে আদি জাতীয়তাবাদীদের (নরমপন্থীদের) অবদান অস্বীকার করা যায় না। কারণ, তাদের হাত দিয়েই ভারতে আধুনিক যুক্তিনির্ভর সাংবিধানিক রাজনীতির প্রবেশ ঘটেছিল ভারতীয় সমাজে।
------------xx-----------
এই প্রশ্নটিই অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- নরমপন্থী আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল কেন?
- নরমপন্থী আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ কী?
- স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে কাদের, কেন নরমপন্থী বলা হয়? এই প্রেক্ষাপটে নরমপন্থী আন্দোলনের গুরুত্ব কতটা?
- ‘আদি জাতীয়তাবাদী’ বলতে কাদের বোঝানো হয়? তাদের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
- নরমপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করো। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই পর্বের আন্দোলনের গুরুত্ব কতটা?
এই বিভাগের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করো।
- জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা কী ছিল?
- নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
- ‘ড্রেন অফ ওয়েলথ’ তত্ত্ব কী?

.png)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন