অথবা,
নয়া সাম্রাজ্যবাদ কী? হবসন-লেনিন থিসিস বলতে কী বোঝ ? এ বিষয়ে হবসন ও লেনিনের মতামত ব্যাখ্যা কর। ২[১+১] + ৩ + ৩ = ৮
অথবা,
ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্বের বৈশিষ্ট বিশ্লেষণ কর। এই তত্ত্বের গুরুত্ব লেখো। ৩ +৩ + ২ = ৮
হবসন-লেনিন থিসিস :
নয়া সাম্রাজ্যবাদ কী? হবসন-লেনিন থিসিস বলতে কী বোঝ ? এ বিষয়ে হবসন ও লেনিনের মতামত ব্যাখ্যা কর। ২[১+১] + ৩ + ৩ = ৮
অথবা,
ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে হবসন-লেনিনের তত্ত্বের বৈশিষ্ট বিশ্লেষণ কর। এই তত্ত্বের গুরুত্ব লেখো। ৩ +৩ + ২ = ৮
হবসন-লেনিন থিসিস :
আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি কোনো দেশের ভুখন্ড দখল না করেও সুকৌশলে সে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের এই আধুনিক কৌশল 'নয়া সাম্রাজ্যবাদ' বা 'নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদ' নামে পরিচিত।
নয়া সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের প্রসারকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। উদারনৈতিক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে. এ. হবসন ও ভি. আই. লেনিন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁদের এই অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা 'হবসন-লেনিন থিসিস' বা 'হবসন-লেনিন তত্ত্ব' নামে পরিচিত।
এই তত্ত্বের মূলকথা হল --
- বাড়তি মূলধনের চাপই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। এই বাড়তি মূলধন বা সম্পদের চাপ সম্পদের সুষম বন্টন ও অভ্যন্তরীণ সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে কাটানো যায় ( হবসন )
- সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ সম্প্রসারিত রূপ। অর্থাৎ পুঁজিবাদের জঠরেই সাম্রাজ্যবাদের জন্ম। পুঁজিবাদী অর্থনীতিই হল যুদ্ধের জন্মদাতা। এই পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য পুঁজিপতিরা অনুগত অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি তৈরি করে ( লেনিন )
হবসনের মতবাদ ও তার বৈশিষ্ঠ :
১৯০২ সালে প্রকাশিত তাঁর 'সাম্রাজ্যবাদ --- একটি সমীক্ষা' গ্রন্থে বলেছেন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ছিল পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিকশিত অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বাভাবিক পরিণতি। তিনি তাঁর গ্রন্থে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে :
- উদ্বৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি : হবসনের মতে, ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকদের হাতে বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর মূলধন সঞ্চিত হয়। এই পাহাড় প্রমাণ মূলধন সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ হল সমাজে ধনসম্পদ বন্টনে ব্যাপক বৈষম্য।
- পুঁজিপতিদের চাপ : এই পাহাড় প্রমাণ 'বাড়তি মূলধনের চাপ-ই সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ দখলের মূল কারণ। পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের উদ্বৃত্ত (বাড়তি) মূলধন উপনিবেশে বিনিয়োগ করে আরও মুনাফা অর্জনের পরিকল্পনা করে।
- উপনিবেশ দখল : এজন্য তারা নিজ নিজ দেশের সরকারকে উপনিবেশ দখলে বাধ্য করে।
- আরও মুনাফা অর্জনের চেষ্টা : হবসন মনে করেন, উপনিবেশ দখলের পর পুঁজিপতি শ্রেণি সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রির বাজার দখল ও উদবৃত্ত মূলধন লগ্নির মাধ্যমে আরও বাড়তি মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে।
- ঔপনিবেশিকতাবাদ অবসানের উপায় : হবসন মনে করেন, এই উপনিবেশ দখলের ঘটনা প্রতিহত করা যায়। তাঁর মতে, পুঁজিপতিদের বাড়তি মূলধন দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় করলে তারা উদবৃত্ত পণ্য সামগ্রী কিনে ব্যবহার করতে পারবে। ফলে এই উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ দখলের প্রয়োজন হবে না।
লেনিনের মতবাদ ও তার বৌশিষ্ট :
রুশ কমিউনিস্ট নেতা ভি. আই. লেনিন ১৯১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর 'সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর' গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে,
- বিপুল পুঁজির উদ্ভব : শিল্পের অগ্রগতির ফলে ইউরোপের দেশগুলির মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে বিপুল পুঁজি সঞ্চিত হয়। এই সঞ্চিত পুঁজি লাভজনকভাবে বিক্রি করার জন্য এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি ইউরোপের পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দখল করে এবং সেখানে পুঁজি লগ্নির উদ্যোগ নেয়।
- বাজার দখল ও কাঁচামাল সংগ্রহ : লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শিল্পমালিকরা বেশি লাভের আশায় দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করে। এই উদ্বৃত্ত পণ্য বিক্রি ও শিল্পোৎপাদনের জন্য সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ দখলের চেষ্টা চালায়।
- পুঁজি বিনিয়োগ : তবে লেনিন উপনিবেশ প্রসারের ক্ষেত্রে শিল্পে পুঁজি বিনিয়গের চেয়ে উপনিবেশে মূলধন বিনিয়োগের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, পুঁজিপতি শ্রেণি উপনিবেশগুলিতেই পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং সেখানেই পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করার চেষ্টা চালায়। তাই, লেনিনের মতে, 'সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ সম্প্রসারিত রূপ।'
- উপনিবেশ দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির উপনিবেশ দখলকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল যুদ্ধ। লেনিনের মতে, 'পুঁজিবাদী অর্থনীতি হল যুদ্ধের জন্মদাতা।' আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পুঁজিবাদী শক্তিগুলি কতৃক উপনিবেশ দখলের লড়াই।
- অনুগত শ্রমিক শ্রেণির জন্ম : লেনিনের মতে, পুঁজিবাদী দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকার শ্রমিক শ্রেণীর ওপর সীমাহীন শোষণ চালায়। ফলে তারা বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে। এই লাভের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিজের দেশের শ্রমিকদের উৎকোচ দিয়ে একধরনের অনুগত 'অভিজাত শ্রমিক শ্রেণি' তৈরী করে। এরা বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে বুর্জোয়াদের সমর্থন করে।
মূল্যায়ন :
সুতরাং বাড়তি পুঁজির চাপ এবং তার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের সম্পর্ক বোঝাটা সহজ হয়ে যায় এই তত্বের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এর কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন চিন্তাবিদরা। যেমন --- হবসন-লেনিন তত্ত্বের ত্রুটি :
- উপনিবেশের বাইরে বিনিয়োগ : অধ্যাপক জে. ডি. ফেজ দেখিয়েছেন, ১৯১৩ সালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ও জার্মানি কর্তৃক বিনিয়োগ করা অর্থের সিংহভাগই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। এর দ্বারা প্রমাণ হয়, উদ্বৃত্ত পুঁজি বিনিয়োগের উদ্দেশ্যেই সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয় নি।
- শিল্পবিল্পবের পূর্বে উপনিবেশ : শিল্পবিপ্ল্ব ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব ও বিকাশ হয় ঊনিশ শতকে। অথচ এর আগে কেন উপনিবেশের উদ্ভব ঘটলো তার কোনো ব্যাখ্যা হবসন-লেনিন তত্ত্বে পাওয়া যায়নি।
- ফ্রান্সের উপনিবেশ বৃদ্ধির ব্যাখ্যা : ১৮১৫ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ফ্রান্সের উপনিবেশ বৃদ্ধির হার ছিল অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। শিল্পে পিছিয়ে থাকা দেশ ফ্রান্সের উপনিবেশ বৃদ্ধির যথার্থ কারণ এই ব্যাখ্যায় পাওয়া যায় না।
- শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান : লেনিনের মতে, শিল্পোন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই ভালো হয়। কিন্তু তাহলে ডেনমার্ক, সুইডেন প্রভৃতি উপনিবেশ না থাকা দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান ফান্স ও বেলজিয়ামের মত সাম্রাজ্যবাদী দেশের চেয়ে উন্নত হয় কিভাবে?
- দুদেশের সুসম্পর্কের উল্লেখ : ব্রিটেনের হাতে বিপুল পুঁজি থাকা সত্ত্বেও তারা কানাডা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতা দিয়েছিল। কারণ, তারা বুঝেছিল উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা নয়, দুদেশের সুসম্পর্কের দ্বারাও অধিক পুঁজি বিনিয়োগ সম্ভব। কিন্তু হবসন-লেনিনের তত্ত্বে এই সুসম্পর্কের কোনো উল্লেখ নেই।
- মৌলিকত্বের অভাব : ডেভিড টমসন দেখিয়েছেন লেনিনের তত্ত্ব মৌলিক ও সম্পূর্ণ নয়।
- গুরুত্ব বা তাৎপর্য :
এই সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও একথা মানতেই হবে সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা হিসাবে এই তত্ত্ব নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। ডেভিড টমসন তাই এই তত্ত্বের মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললেও উপনিবেশ দখলের অর্থনৈতিক তাগিদকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ঊনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপীয় দেশগুলি কতৃক সাগরপারে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র সন্ধানের আগ্রহ তাদের উপনিবেশ দখলে বিশেষ উদ্যোগী করে তুলেছিল।' প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রায় ত্রিশ হাজার মিলিয়ন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ তার প্রমাণ।
-----------------//-------------------
sir whatsapp number ta paoya jabe
উত্তরমুছুন