ক্ষমতা হস্তান্তরের পটভূমি উল্লেখ করো। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশের ভূমিকা ও ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করো।
ক্ষমতা হস্তান্তর :
ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা ব্রিটিশ সরকার অনুমোদন করার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩ রা জুন ১৯৪৭ তাঁর ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা 'মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব' নামে পরিচিত। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ এই প্রস্তাব মেনে নিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 'ভারতের স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭' পাশ করে এবং ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করে। এই ঘটনা 'ক্ষমতা হস্তান্তর' নামে পরিচিত।
ক্ষমতা হস্তান্তরের পটভূমি :
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর ঘটনা পরম্পরা অতি দ্রুত ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দেয় যে ভারতবাসীর হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এগিয়ে আসছে।
- ভারত ছাড়ো আন্দোলন : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে মুক্তি সংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। বড়লাট ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে লেখেন, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের দিন শেষ হয়েছে।'
- আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম : আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রবল বীরত্ব ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দেশবাসীর মনে প্রবল জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলে। প্রবল গণবিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছিল যে ভারতে তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
- ওয়াভেল পরিকল্পনা : উদ্ভুত পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রিসভাকে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নিতে বলেন। তিনি তাঁর প্রস্তাবে শীঘ্রই ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন।
- বৃহৎ শক্তির চাপ : ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি সামনে রেখে বৃহৎ দুই শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটেনকে চাপ দিতে থাকে। একই সঙ্গে ব্রিটেনের শ্রমিক দলও চার্চিলের ওপর চাপ বাড়াতে থাকে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে।
- শ্রমিক দলের ক্ষমতা লাভ : ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনে শ্রমিক দল ক্ষমতা লাভ করলে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ভারতে 'মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশন পাঠান ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে আলোচনার জন্য।
- ক্যাবিনেট মিশন : ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলেও ক্যাবিনেট মিশন জানায়, ব্রিটিশ শাসিত ও দেশিও রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে এবং শাসনতন্ত্র রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে। শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শাসন পরিচালনা করবে।
- নৌবিদ্রোহ : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ আন্দোলন হল ১৯৪৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের নৌবিদ্রোহ। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি এর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
- গণপরিষদ গঠন : মন্ত্রীমিশনের পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪৬ সালে গণপরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মুসলিম লিগ গণপরিষদের গঠন ও কর্মধারাকে বে-আইনি ঘোষণা করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ঘোষণা করেন ৩০শে জুনের মধ্যে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
- মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা : ১৯৪৭ সালের মার্চে মাউন্টব্যাটেন বড়লাট হয়ে আসেন। ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ দ্রুত করার জন্য এসে তিনি বুঝতে পারেন, ভারত বিভাগ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
- ভারতের স্বাধীনতা আইন : এই পরিস্থিতিতে মাউন্টব্যাটেন তাঁর প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাব কংগ্রেস ও লিগ মেনে নিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট 'ভারতের স্বাধীনতা আইন' পাশ করে এবং ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করে।
এভাবে আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীন ঘটনাবলীর প্রভাবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্টের জন্মের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া কার্যকর হয়।
ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা :
ব্রিটিশ সরকার কখনই ক্ষমতা হস্তান্তর চান নি। পরিস্থিতি তাঁদের একাজে রাজি হতে বাধ্য করেছিল।
- ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পিছনে দায়ী ছিল জিন্নার অন্যায্য দাবি, যা ব্রিটিশ সরকার প্রশ্রয় দিয়েছিল।
- কিন্তু মন্ত্রীমিশন প্রেরণের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কারণ শ্রমিক দলের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ২০ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭, ঘোষণা করেন আগামী ৩০ সে জুনের মধ্যে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।
- মাউন্টব্যাটেন গান্ধিজির মতই অখন্ড ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু জিন্না ও জওহরলাল নেহেরুর অনড় মনোভাবের কারণে গান্ধিজির এই ইচ্ছাকে তিনি কার্যকর করতে পারেন নি। এই পরিস্থিতিতে তিনি উপলব্ধি করেন যে ভারত বিভাগ ছাড়া উপায় নেই। তাই ঘোষণা করেন 'মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব বা 'Mountbatten Award.
মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগের প্রস্তাবে বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
- সর্দার ও নেহেরুর চাপে গান্ধিজি ভারত বিভাগ মেনে নিযেছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া হল : 'সর্দার ও জওহরলাল মনে করে যে, দেশ ভাগ হলে নাকি শান্তি ফিরবে। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, দেশভাগের মূল্যে আমরা যে স্বাধীনতা পাচ্ছি তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।'
- আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভারত ভাগ হল কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরাজয়ের শামিল।
- বল্লভভাই প্যাটেল মনে করেন, ভারতভাগ কংগ্রেসের পরাজয় বা নতিস্বীকার নয়, তৎকালীন পরিস্থিতিতে দেশভাগই ছিল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।
- রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, গৃহযুদ্ধের চেয়ে দেশভাগ ভালো।
- জিন্নাও খুশি হন নি। পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের কারণে মাউন্টব্যাটেন ঘোষিত পাকিস্তানকে তিনি 'বিকলাঙ্গ ও কীটদগ্ধ' বলে অভিহিত করেছেন।
----------------///-----------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন