অথবা,
ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইন্দোচিনের পরিবর্তিত অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এ প্রসঙ্গে হো-চি-মিনের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
ইন্দোচিন
ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
অথবা,
হো-চি-মিন কে ছিলেন? ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কী ছিল?অথবা,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইন্দোচিনের পরিবর্তিত অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এ প্রসঙ্গে হো-চি-মিনের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
ইন্দোচিন
ফরাসিরা ১৮৫৭ সালে কোচিন চিন ও কম্বোডিয়া অধিকার করে। এর পর একে একে ভিয়েতনাম, টংকিং, আন্নাম দখল করে ১৮৮৭ সালে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলে। ফরাসি অধিকৃত এই অঞ্চলই 'ইন্দোচিন' নামে পরিচিত।
ক) মুক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্যায় :
ক) মুক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্যায় :
- ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও ইন্দোচিন :
বিংশ শতকের প্রথম দিক থেকে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইন্দোচিনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। যাঁর নেতৃত্বে এই আন্দোলন সাফল্যের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছায় তিনি হচ্ছেন ভিয়েতনাম মুক্তি-সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হো-চি-মিন।
- জাপানি সাম্রাজ্যবাদ ও ইন্দোচীন :
ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির কাছে ফ্রান্স বিধ্বস্ত হলে তারা ইন্দোচিন থেকে সরে আসে। এই সুযোগে জার্মানির মিত্র দেশ জাপান সেখানে আধিপত্য গড়ে তোলে। ১৯৪৫ সালে অগস্টে জাপান মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করলে ভিয়েতমিন নেতা হো-চি-মিন টংকিং-এর হ্যানয় দখল করে 'ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন হো-চি-মিন।
- ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা :
১) হো-চি-মিন সরকারকে স্বীকৃতি :
১৯৪৫ সালে পিটসডম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইন্দোচিনকে দুভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরাঞ্চল হো-চ-মিনের হাতে রাখা হয় এবং দক্ষিণাঞ্চল আবার ফরাসিদের কতৃত্বে আসে। ফরাসিরা এই সময় সমগ্র ভিয়েতনামের ওপর কতৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা শুরু করে। অবশেষে ভিয়েতমিন গেরিলা বাহিনীর আক্রমনে ফ্রান্স ব্যতিব্যস্ত হয়ে ১৯৪৬ সালে ভিয়েতমিনের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী ফ্রান্স হো-চি-মিন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
২) বাও দাই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :
২) বাও দাই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্স এই চুক্তি ভঙ্গ করে আনম রাজবংশের বাও দাইকে ভিয়েতনামের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। শুধু তাই নয় নভেম্বর মাসে হাইফঙ বন্দর ও সংলগ্ন অঞ্চলে বোমা ফেলে ৬০০০ অসামরিক মানুষকে হত্যা করে।
৩) দিয়েন-বিয়েন-ফু-এর যুদ্ধ :
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভিয়েতমিনরা ফরাসি অধিকৃত টংকিং আক্রমণ করে। শুরু হয় দীর্ঘ আট বছর ব্যাপী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের শেষ দিকে ক্রমাগত পরাজয় ঠেকাতে ফ্রান্স দিয়েন-বিয়েন-ফু নামক স্থানে একটি সশস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করে। খবর পেয়ে ভিয়েতমিন সেনাপতি নগুয়েন গিয়াপ এই ঘাঁটি ধ্বংস করেন। ফলে ফ্রান্স হো-চি-মিন সরকারের সঙ্গে জেনেভা চুক্তি করতে বাধ্য হন।
খ) মুক্তি সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় :
১) দিয়েম সরকার প্রতিষ্ঠা :
আমেরিকা তার অনুগ্রহপুষ্ট ন দিন দিয়েম-কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে --
৩) দিয়েন-বিয়েন-ফু-এর যুদ্ধ :
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভিয়েতমিনরা ফরাসি অধিকৃত টংকিং আক্রমণ করে। শুরু হয় দীর্ঘ আট বছর ব্যাপী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের শেষ দিকে ক্রমাগত পরাজয় ঠেকাতে ফ্রান্স দিয়েন-বিয়েন-ফু নামক স্থানে একটি সশস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণ করে। খবর পেয়ে ভিয়েতমিন সেনাপতি নগুয়েন গিয়াপ এই ঘাঁটি ধ্বংস করেন। ফলে ফ্রান্স হো-চি-মিন সরকারের সঙ্গে জেনেভা চুক্তি করতে বাধ্য হন।
- ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :
- ১৯৫৪ সালে এই সম্মেলনে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
- দক্ষিণ ভিয়েতনামে বাও-দাইয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিরোধী সরকার (ন দিন দিয়েম) ক্ষমতা লাভ করে।
- ভারতের নেতৃত্বে জাতিপুঞ্জের তদারকি কমিটির দ্বারা দুবছর পর নির্বাচন করে দুই অংশের সংযুক্তির বিষয় মিমাংশিত হবে - এই সিদ্ধান্ত হয়।
খ) মুক্তি সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায় :
- আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও ইন্দোচিন :
১) দিয়েম সরকার প্রতিষ্ঠা :
আমেরিকা তার অনুগ্রহপুষ্ট ন দিন দিয়েম-কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে --
- দিয়েম সরকারকে প্রচুর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে থাকে।
- সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্যবাদ প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স ও পাকিস্তানকে নিয়ে সামরিক চুক্তি করে। এই চুক্তি 'ম্যানিলা চুক্তি' নামে পরিচিত।
- এছাড়া উক্ত দেশগুলিকে নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বে 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা' (South-East Asia Treaty Organisation) বা 'সিয়াটো' গড়ে তোলে।
- উত্তর ভিয়েতনামে হো-চি-মিন সরকার বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও জনগণের মধ্যে জমি বন্টন করে মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন।
- অন্যদিকে দিয়েম সরকার স্বৈরাচারি ও দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ায় এই সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়ে।
- এই পরিস্থিতিতে হো-চি-মিন-এর সহযোগিয়ায় দক্ষিণ ভিয়েতনামে ১৯৬০ সালে 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গড়ে ওঠে যা 'ভিয়েত কং' নামে পরিচিত। ফলে এই ফ্রন্টের সঙ্গে দিয়েম সরকারের সঙ্ঘর্ষ শুরু হয়।
- ১৯৬২ সালে ভিয়েত কং-দের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমানবাহিনী যৌথ আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণের পর দিয়েম সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল গণ আন্দোলন শুরু হয়। কিছুদিনের মধ্যেই এক সামরিক অভ্যুথানের ফলে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে।
১৯৬৫ সাল থেকে ভিয়েতনামে প্রত্যক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপ বাড়তে থাকে। যুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরক দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। ১৯৬৮ সালে মার্কিন সেনা মাই লাই গ্রামে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটায় যা 'মাই লাই ঘটনা' নামে পরিচিত। এর প্রতিবাদে ভিয়েত কং ও উত্তর ভিয়েতনামের সেনা বাহিনী একযোগে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৪৪ টি প্রাদেশিক রাজধানী শহর আক্রমণ করে।
৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় :
১৯৬৯ সালে হো-চি-মিনের মৃত্যুর ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যের আক্রোশ চরমে পৌঁছায়।আমেরিকার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব ও-থান্ট বলেন, এই যুদ্ধ একটি বিদেশি শক্তি, বিশেষত আমেরিকানদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। ফলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন উপলব্ধি করেন, ভিয়েতনামে মার্কিন জঙ্গিনীতি আর চলবে না। ১৯৭৩ সালে আমেরিকা ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা ও বিমানবাহিনী সরিয়ে নেওয়া হয়।
গ) ভিয়েতনামের ঐক্য :
১৯৭৫সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সেনাপতি ভ্যান মিন ভিয়েত কং-এর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম সংযুক্ত হয়। জন্ম নেয় ঐক্যবদ্ধ 'ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' যার প্রথম রাষ্ট্রপতি হন ফাম ভান দং। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভিয়েতনাম ঐক্য আন্দোলন সাফল্যের দোঁড়গোড়ায় পৌঁছায় যার সীমাহীন আত্মত্যাগে তিনি হচ্ছেন ভিয়েতনাম মুক্তি-সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হো-চি-মিন।
--------------//--------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন