কোরিয়া সংকট :
১৯১০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪৫) পর্যন্ত কোরিয়া ছিল জাপানের অধীনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া কোরিয়াকে ভাগাভাগি করে নেয়। উত্তর ভাগ সোভিয়েত রাশিয়া এবং দক্ষিণভাগ আমেরিকার অধিকারে যায়। প্রথমে ভাবা হয়েছিল এই বিভাজন ক্ষণস্থায়ী হবে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দুই পক্ষই নিজ নিজ অধিকৃত এলাকায় নিজ নিজ মতাদর্শ অনুযায়ী অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করলে কোরিয়া ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবর্তে জড়িয়ে যায়। তৈরি হয় কোরিয়া সংকট।
কোরিয়া সংকটের কারণ :
- মস্কো বৈঠকের ব্যর্থতা : ১৯৪৫ সালে মস্কোয় সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে ঠিক হয় উভয় পক্ষকে নিয়ে কোরিয়া বিষয়ে একটি যুগ্ম কমিশন গঠিত হবে। এই কমিশন কোরিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি অস্থায়ী স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
- রুশ-মার্কিন বিরোধ : ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে যুগ্ম কমিশনের এক সভায় সোভিয়েত রাশিয়া কোরিয়া থেকে রুশ-মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে। কিন্তু আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের কারণে তারা তার বিরোধিতা করে।
- জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ ও তার ব্যর্থতা : ১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে জাতিপুঞ্জে একটি অস্থায়ী কমিশন গঠন করা হয়। ভারতের অর্থনীতিবিদ কে.পি.এস.মেমন এর নেতৃত্বে এই কমিশন উত্তর কোরিয়ায় ঢুকতে চাইলে রাশিয়া অনুমতি দে নি।
- মার্কিন অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা : এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালে আমেরিকার মদতে ও জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। এর নাম হয় 'রিপাবলিক অফ কোরিয়া'। রাষ্ট্রপ্রধান হন সিগম্যান রি। ফলে কোরিয়ার সংযুক্তি গভীর সংকটে পড়ে যায়।
- সোভিয়েত অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা : এর পাল্টা হিসাবে রাশিয়া ১৯৪৮ সালের কিম-উল-সুং এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেন 'পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কোরিয়া'। ফলে কোরিয়া সংযুক্তি আরও গভীর সংকটে পড়ে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন একাধিপত্য সোভিয়েত রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। তাই ১৯৫০ সালে রুশ মদতে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে। ফলে দুই কোরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়।
⦿ আমেরিকার প্রতিক্রিয়া :
⦿ আমেরিকার প্রতিক্রিয়া :
যুক্তরাষ্ট্র এটাকে সমাজতন্ত্রের আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাহায্যে এগিয়ে আসে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করে এবং জাতিপুঞ্জের সকল সদস্য রাষ্ট্রের কাছে দক্ষিণ কোরিয়ারকে সাহায্য করার আবেদন জানান। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সেনাপতি ম্যাক আর্থারের নেতৃত্বে জাতিপুঞ্জের পতাকা নিয়ে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।
⦿ উত্তর কোরিয়ার সাফল্য :
⦿ উত্তর কোরিয়ার সাফল্য :
জাতিপুঞ্জের সহযোগিতা সত্ত্বেও দক্ষিণ কোরিয়া পিছিয়ে পড়ে। উত্তর কোরিয়া ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ ভুখন্ড দখল করে নেয়।
⦿ দক্ষিণ কোরিয়া দখলমুক্ত :
⦿ দক্ষিণ কোরিয়া দখলমুক্ত :
পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেরিকা এই অঞ্চলে নতুন করে সেনা ও অস্ত্র মোতায়েন করে। ফলে জাতিপুঞ্জের বাহিনী গতি বাড়িয়ে দক্ষিণ কোরিয়া দখলমুক্ত করে।
⦿ দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য :
⦿ দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য :
সেনাপতি ম্যাক আর্থার উৎসাহিত হয়ে ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ার দখল করে চিন সীমান্তে পৌঁছে যায়।
⦿ চীনের পাল্টা আক্রমন : চীনের ভূখণ্ডে জাতিপুঞ্জের নামে মার্কিন আধিপত্য মাও-সে-তুং মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে চিনা বাহিনী জাতিপুঞ্জের বাহিনীকে বিতাড়িত করে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল পর্যন্ত দখল করে নেয়।
যুদ্ধের সমাপ্তি :
এইভাবে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ চিন-মার্কিন যুদ্ধে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক চাপে রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান সেনাপতি ম্যাক অর্থারকে বরখাস্ত করলে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালে জুলাই মাসে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।
ফলাফল বা গুরুত্ব :
আপাত দৃষ্টিতে কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি নিরর্থক যুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল ও গুরুত্ব ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কোরিয়া সংকট সমাধানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কখনও আমেরিকার মতের সঙ্গে সহমত হয়ে কখনও বিরোধিতা করে এই সংকটের রাশ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
⦿ চীনের পাল্টা আক্রমন : চীনের ভূখণ্ডে জাতিপুঞ্জের নামে মার্কিন আধিপত্য মাও-সে-তুং মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে চিনা বাহিনী জাতিপুঞ্জের বাহিনীকে বিতাড়িত করে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল পর্যন্ত দখল করে নেয়।
যুদ্ধের সমাপ্তি :
এইভাবে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ চিন-মার্কিন যুদ্ধে পরিণত হয়। আন্তর্জাতিক চাপে রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান সেনাপতি ম্যাক অর্থারকে বরখাস্ত করলে পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়। অবশেষে ১৯৫৩ সালে জুলাই মাসে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়। ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।
ফলাফল বা গুরুত্ব :
আপাত দৃষ্টিতে কোরিয়ার যুদ্ধ ছিল একটি নিরর্থক যুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল ও গুরুত্ব ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
- ঐক্য অধরাই থাকে : দুই কোরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যকে এই যুদ্ধ পূরণ করতে পারেনি। বরং উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস প্রবল হয়ে ওঠে।
- বিভাজন স্থায়ীরূপ পায় : দুই কোরিয়ার বিভাজন মোটামুটি স্থায়ী রূপ পায়।
- অর্থনীতি বিধ্বস্ত : দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধ দুই কোরিয়ার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছিল? ৪ মিলিয়ন মানুষ মারা যান।
- ঠান্ডা লড়াই প্রসার : এই যুদ্ধ ঠান্ডা লড়াইকে ইউরোপ ছাড়িয়ে এশিয়ার ভূখণ্ডে এনে ফেলে। আমেরিকার বিরুদ্ধে রাশিয়া চিনকে পাশে পেয়ে যায়।
- জাতিপুঞ্জের মর্যাদা নষ্ট : জাতিপুঞ্জে রাশিয়া অনুপস্থিত থাকায় আমেরিকা তাকে একতরফা ব্যবহার করে এই যুদ্ধে। ফলে জাতিপুঞ্জের নিরপেক্ষ চরিত্র ও মর্যাদা অনেকটা নষ্ট হয়।
- রুশ-চিন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ : এই যুদ্ধের দ্বারা মার্কিন-চিন বিরোধ বৃদ্ধিপায় এবং রুশ-চিন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়।
- পরিবর্তিত মার্কিন নীতি : এতদিন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নীতি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-বিরোধী। এই যুদ্ধের সময় তা হয়ে ওঠে সাম্যবাদ বিরোধী।
- সামরিক জোট গঠন : কোরিয়া যুদ্ধের পর আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও এশিয়া মহাদেশে বিভিন্ন সামরিক জোট গঠনে উদ্যোগ নেয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'ANZUS', 'SEATO' ইত্যাদি। এছাড়া ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, আরও ৪৮ টি দেশের সঙ্গে আমেরিকা নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষর করে।
কোরিয়া সংকট সমাধানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কখনও আমেরিকার মতের সঙ্গে সহমত হয়ে কখনও বিরোধিতা করে এই সংকটের রাশ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
- কোরিয়া সমস্যা সমাধানে গঠিত জাতিপুঞ্জের অস্থায়ী কমিশন ( ANTCOK ) গঠিত হলে ভারত তার নেতৃত্ব দেয়। সভাপতি হিসাবে কে.পি.এস.মেনন বড়ো শক্তিগুলিকে কোরিয়া বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে পরামর্শ দেয়।
- জাতিপুঞ্জ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী হিসাবে ঘোষণা করলে ভারত তা সমর্থন করে।
- জাতিপুঞ্জ কোরিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সাহায্যের অনুরোধ জানালে ভারত তাকে সমর্থন জানায়।
- ভারত শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা মেটাতে বললে আমেরিকা তাকে 'আগ্রাসনের প্রতি তোষণ' বলে অগ্রাহ্য করে। এরপর আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিপুঞ্জ উত্তর কোরিয়ায় ঢোকার চেষ্টা করলে ভারত এর বিরোধিতা করে বলে, 'মার্কিন জাতিপুঞ্জকে NATO -র বৃহত্তর সংস্করণে পরিণত করেছে।'
- জাতিপুঞ্জ চিনকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা করলে ভারত তারও বিরোধিতা করে বলে, 'চিন আগ্রাসনের মনোভাব নিয়ে এই যুদ্ধে যোগ দে নি -- আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েছে।'
- যুদ্ধ বিরতির ক্ষেত্রে ও বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রেও ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
---------------//--------------
কপি অথবা পিডিএফ হলে ভালো হতো
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন