ক্যান্টন বাণিজ্য কী? ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর। ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানের কারণ কী ছিল?
অথবা,
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল আলোচনা কর।
What is Canton Trade? Characteristics of Canton Trade. Caused the end of the Canton trade
ক্যান্টন বাণিজ্য কী?
চিনের দক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত ক্যান্টন বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত এই বন্দরই ছিল বিদেশি বণিকদের কাছে একমাত্র উন্মুক্ত বন্দর। কারণ, ১৭৫৯ সালে চিনা আদালত একমাত্র ক্যান্টন বন্দরকেই বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বলে ঘোষণা করে। এভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চিনে বিদেশীদের এক-বন্দরকেন্দ্রিক যে বাণিজ্য প্রথার সূচনা হয় তা-ই ‘ক্যান্টন বাণিজ্য’ নামে পরিচিত। এই ‘ক্যান্টন বাণিজ্য’ ‘ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা’ নামেও পরিচিত।
ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য :
ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান প্রধান শর্ত, যা বিদেশি বণিকদের মেনে চলতে হতো, তা বিশ্লেষণ করলেই ক্যান্টন বাণিজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নজরে পড়বে।
১) ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক বাণিজ্য :
ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালিত হতো ‘কো-হং’ নামে একটি ঘনিষ্ঠ বণিকসংঘ দ্বারা। এই বণিক সংঘ ছিল মূলত ব্যক্তি মালিকানাধীন। এদের মাধ্যমেই বিদেশী বণিকদের বাণিজ্য করতে হতো।
২) চীনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কহীন বাণিজ্য :
ক্যান্টন বাণিজ্যের জন্য বিদেশী বণিকদের চিনা সরকারের সঙ্গে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার দরকার হতো না।
৩) প্রত্যক্ষ বাণিজ্যে বাধা :
বিদেশি বণিকরা সরাসরি ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করতে পারত না। অর্থাৎ তারা চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রত্যক্ষভাবে বাণিজ্য পণ্য কিনতে পারত না। সরকার অনুমোদিত ‘কো-হং’ বণিক সংঘের মাধ্যমেই তাদের লেনদেন চালাতে হতো।
৪) বিদেশীদের মূল শহরে প্রবেশে বাধা :
বিদেশি বণিকদের ক্যান্টন বন্দরের প্রধান ফটক পেরিয়ে মূল শহরে প্রবেশ করতে পারত না।
৫) ‘কো-হং’ বণিক সংঘের দুর্নীতি :
ক্যান্টন বন্দরের দায়িত্বে থাকা ‘কো-হং’ বণিক সংঘের বণিকরা ছিল অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা চিনা রাজদরবার, আদালত ও শুল্ক অধিকর্তাকে ঘুষ দিয়ে ক্যান্টন বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। ফলে বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যের শর্ত তারাই ঠিক করত এবং বাণিজ্যের বেশিরভাগ লভ্যাংশ তারাই আত্মসাৎ করতো।
৬) রুদ্ধ দ্বার নীতি :
ক্যান্টন বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী বিদেশী বণিকদের
১) চিনা ভাষা ও আদব-কায়দা শেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
২) বণিকদের চিনা ফৌজদারি ও বাণিজ্যিক আইন মেনে চলা বাধ্যতামূলক ছিল।
৩) বণিকরা তাদের স্ত্রী-পুত্রদের ক্যান্টন বন্দর থেকে দূরবর্তী ম্যাকাও দ্বীপে রেখে আসতে বাধ্য হত।
৪) বিদেশি বাণিজ্য কুঠিতে মহিলা ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ এবং দাসী নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল
৫) বাণিজ্যের মরশুম শেষ হলে বণিকদের ক্যান্টন বন্দর ত্যাগ করতে হতো।
চীনে বিদেশি বণিকদের প্রতি আরোপ করা এই সব কঠোর নীতি ‘রুদ্ধদ্বার নীতি’ নামে পরিচিত।
ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানের কারণ :
ক্যান্টন বাণিজ্যে নানা ধরণের কঠোর শর্ত এবং বিধিনিষেধ বিদেশি বণিকদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এই ক্ষোভই ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
১) বিদেশীদের ব্যবসা বন্ধের হুমকি :
পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলো ক্যান্টন বাণিজ্যের কঠোর শর্ত ও বিধে নিষেধ গুলি শিথিল করার দাবি করলে তাদের ব্যবসা বন্ধের হুমকি দেয়া হতো।
২) বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থতা :
ব্যবসা বন্ধের হুমকি সহ অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য ইংল্যান্ড একাধিকবার দূত পাঠায়। ১৭৮৭ সালে চার্লস ক্যাথকার্ট, ১৭৯৩ সালে লর্ড আমহার্স্ট চেষ্টা করেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়। ফলে ইংল্যান্ড বল প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে।
৩) চোরাপথে আফিম ব্যবসা :
উনবিংশ শতকের শুরু থেকে ব্রিটিশ বণিকরা চোরাপথে ভারত থেকে চীনে আফিম রপ্তানি শুরু করলে চিন সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধ বাধে।
৪) প্রথম আফিম যুদ্ধ বা প্রথম ইঙ্গ-চিন যুদ্ধ :
চোরাপথে আফিন রপ্তানি কে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই বিরোধ ১৮৩৯ সালে যুদ্ধের রূপ নেয়। এই যুদ্ধ প্রথম আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২) নামে পরিচিত।
৫) প্রথম আফিম যুদ্ধে চিনের পরাজয় :
প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কারণ, ১৮৪২ সালে নানকিং সন্ধির সন্ধির শর্ত অনুযায়ী চীন ক্যান্টনবন্দর সহ বেশ কয়েকটি বন্দর বিদেশিদের জন্য খুলে দিতে বাধ্য হয়।
এভাবে চিনের ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার অবসান ঘটে।
-------xx-----
ক্যান্টন বাণিজ্যের পতন: কারণ এবং প্রভাব
উত্তরমুছুন