কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য। কিংবদন্তি ও লোককথার পার্থক্য।
Features of the legend. Difference Between Legend and Folktale
কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
১) কিংবদন্তের উদ্ভব :
অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, পৌরাণিক কাহিনী সৃষ্টির বহু যুগ পর মানব সমাজে যখন ইতিহাসবোধ জন্ম নিতে শুরু করে তখনই কিংবদন্তি গুলির পথ চলা শুরু হয়।
২) কিংবদন্তির উদ্দেশ্য :
কোন ঘটনাকে প্রচার করা এবং জনমানসে তাকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই কিংবদন্তি বা বিরগাথা গুলি সৃষ্টি করা হয়।
৩) বিষয়বস্তুর বিভিন্নতা :
কিংবদন্তির বিষয়বস্তু বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন, ইতিহাস নির্ভর কাহিনি, প্রেম বিরহের কাহিনি, ভূত-প্রেত এর কাহিনি কিম্বা সন্ন্যাসী ফকির পীর দরবেশদের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কাহিনি।
৪) লোকসংস্কৃতির অংশ :
প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকমুখে প্রচলিত হওয়ার কারণে কিংবদন্তিগুলির মধ্যে লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ( লোকবিশ্বাস ও সংস্কার) যুক্ত হয়েছে। তাই কিংবদন্তিগুলো লোকসমাজের দর্পণে পরিণত হয়।
৫) চরিত্রের বাস্তবতা :
কিংবদন্তির চরিত্রগুলোর ঐতিহাসিক সত্যতা সব সময় না থাকলেও জনমানসে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে থাকে যে অতীত কালে তাদের অস্তিত্ব ছিল এই পৃথিবীতে। যেমন হারকিউলিস, প্রমিথিউস, রামচন্দ্র প্রমূখ
৬) বিস্ময় ও কল্পনার প্রেক্ষাপট :
বিস্ময় ও কল্পনা কিংবদন্তির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সক্রিয় থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় কিংবদন্তির চরিত্রগুলোতে ঐতিহাসিক সত্যের ইঙ্গিত থাকলেও পরবর্তীকালে কল্পনার পল্লবীত পাতায় আচ্ছাদিত হয়ে প্রকৃত ইতিহাস প্রায় মুছে যায়। ফলে কিংবদন্তি থেকে সঠিক ইতিহাস উদ্ধার করার কাজ খুবই জটিল ও কঠিন হয়ে পড়ে।
৭) ভিত্তিহীন ঘটনার অস্তিত্ব :
অতীতের কোন ব্যক্তির বাস্তব জীবনের সঙ্গে বিভিন্ন অতি মানবীয়, অবিশ্বাস্য ও অতিরঞ্জিত ঘটনা যুক্ত হয়ে কিংবদন্তির চরিত্রগুলো হয়। তাই কিংবদন্তির মধ্যে বিভিন্ন ভিত্তিহীন ঘটনার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
৮) নৈতিক শিক্ষার উৎস :
কিংবদন্তির কাহিনী গুলোতে বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে অতীত সময়ের নৈতিকতা সততা বীরত্ব ও ত্যাগের মহিমা কীর্তন করা হয়। ফলে এগুলো থেকে বর্তমান কালের মানুষেরা নৈতিক শিক্ষার রসদ খুঁজে পায়।
কিংবদন্তি ও লোককথার পার্থক্য
লোককথা ও কিংবদন্তীর বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করলে উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় :১) শিশু কেন্দ্রিকতা :
কিংবদন্তির কাহিনীগুলিতে যে সকল বিষয় থাকে তাতে সকল বয়সি মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ থাকে।কিন্তু লোককথায় সাধারণত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ থাকে।
২) রচয়িতার পরিচয়হীনতা :
লোককথার মূল রচিতাদের পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। জানা যায় সংকলকদের কথা।অন্যদিকে কিংবদন্তের চরিত্রগুলির সৃষ্টিকর্তা বা রচয়িতাদের সম্পর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, রামচন্দ্র বাল্মিকি এবং শ্রীকৃষ্ণ ব্যাসদের দ্বারা রচিত।
৩) ধর্মীয় বিষয়ের গুরুত্বহীনতা :
লোককথার কাহিনীগুলিতে ধর্মীয় বিষয়বস্তু বিশেষ গুরুত্ব পায় না।কিন্তু কিংবদন্তির চরিত্রগুলি যেসব কাহিনীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, সেখানে কখনও কখনও ধর্মীয় অনুসঙ্গ যুক্ত থাকে। রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ কিংবদন্তির এই চরিত্র দুটোই এমনই ধর্মীয় অনুষঙ্গ যুক্ত।
৪) মানবকেন্দ্রিক বিষয়বস্তু :
লোককথার বর্ণনায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের বিষয়গুলি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।অন্যদিকে, কিংবদন্তির বিষয়বস্তু নানামুখী। সেখানে ইতিহাস নির্ভর, প্রেম বিরহ নির্ভর, আধ্যাত্মিক ঘটনা নির্ভর, এমনকি ধর্মীয় অনুষঙ্গ নির্ভর বিষয়গুলি বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
৫) ইতর প্রাণে ব্যক্তিত্ব আরোপ :
লোককথার গল্পগুলিতে বিভিন্ন পশু পাখি ও কীট পতঙ্গের মধ্যে মানুষের মতো ব্যক্তিত্ব আলোকিত হতে দেখা যায়। তারা মানুষের মতো কথা বলে এবং নিজেদের চিন্তার প্রকাশ ঘটায়।কিন্তু কিংবদন্তির কাহিনীগুলোতে এই ধরনের ইতর প্রাণে ব্যক্তিত্ব আরপের ঘটনা সাধারণত লক্ষ্য করা যায় না
৬) অনির্দিষ্ট স্থান কাল পাত্র :
লোককথার গল্পে ঘটনার স্থান-কাল পাত্রের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকে না। একতা এক দেশে এক রাজা ছিল - এভাবে গল্পগুলো শুরু হয়।কিন্তু কিংবদন্তের কাহিনীগুলির মোটামুটি স্থান-কাল পাত্রের হদিশ পাওয়া যায়। হারকিউলিস গ্রিসের, গোপাল ভার বাংলাদেশের কিংবদন্তি চরিত্র।
৭) কাল্পনিক চরিত্রের উপস্থিতি :
লোকোকথার চরিত্রগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে তার তেমন মিল নেই বললেই চলে। সাত ভাই চম্পা, আলিবাবা, লখিন্দর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’র আংলা - এমনি সাপ কাল্পনিক চরিত্র।অন্যদিকে কিংবদন্তির চরিত্রগুলি বাস্তব রূপ আছে বলে বলা হয়। গোপাল ভাঁড়, হারকিউলিস, বিক্রমাদিত্য, রবিনহুড ইত্যাদি চরিত্রগুলো রক্তমাংসের চরিত্র ছিল বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে আরো প্রশ্ন পড় :
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন