উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় কর
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পার্থক্য :
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ শব্দ দুটির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, উভয় শব্দই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে কল্পনা করা যায় না। তা সত্ত্বেও এই শব্দ দুটির মধ্যে যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে উভয়ের মধ্যে কিছু পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়।
১) উৎসগত পার্থক্য :
‘উপনিবেশবাদ’ কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘কলোনি’ থেকে, যার অর্থ হল উপনিবেশ।
অন্যদিকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ইম্পোরিয়াম’ থেকে, যার অর্থ সর্বময় কর্তৃত্ব।
২) সংজ্ঞাগত পার্থক্য :
দেশের সীমান্তের বাইরে অথবা সীমান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন এবং তাকে শোষণের জন্য দখল করার রাজনৈতিক মতবাদ হল উপনিবেশবাদ।
অন্যদিকে, যখন কোন জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য কোন জনগোষ্ঠীর উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে তখন তাকে বলে সাম্রাজ্যবাদ। এ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয় উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
৩) শব্দ দুটির প্রাচীনত্ব সংক্রান্ত পার্থক্য :
উপনিবেশবাদের ধারণা সাম্রাজ্যবাদের ধারণার তুলনায় নতুন। উপনিবেশবাদের স্থান মোটামুটি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর পর থেকে।
অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদের ধারণা বহু পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য এবং রোম সাম্রাজ্যের ধারণা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
তবে মনে রাখতে হবে, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব উপনিবেশবাদের পরে। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে সূচনা এবং উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে তার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে।
৪) উদ্দেশ্য গত পার্থক্য :
উপনিবেশ শব্দটির মূল অর্থ হলো মানব সমাজের একটি স্থানান্তরিত অংশ। অর্থাৎ দেশের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা অন্য দেশে পুনর্বাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে বসতি স্থাপনই হলো উপনিবেশবাদের উদ্দেশ্য।
কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পর রাজ্য গ্রাস করা এবং সেখানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
৫) শ্রেণীবিভাগগত পার্থক্য :
উপনিবেশবাদের তেমন কোন শ্রেণীবিভাগ নেই। তবে তার পরিবর্তিত রূপ হিসাবে বর্তমানে নয়া উপনিবেশবাদ কথাটি ব্যবহার করে থাকেন।
অন্যদিকে প্রকৃতিগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করে সাম্রাজ্যবাদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যেমন, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি।
৬) বসবাসের প্রকৃতিগত পার্থক্য :
উপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে প্রচুর মানুষ নতুন উপনিবেশে বসবাসের জন্য আসে। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা সঙ্গে উদ্বৃত্ত মানুষের উপনিবেশে প্রীতি পূর্ণ পরিবেশে বসবাসের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে এমনটা নাও ঘটতে পারে। সেখানে শক্তিশালী বিজয়ী রাষ্ট্র বিদেশি শাসক হিসেবেই উপনিবেশ শাসন করে থাকে।
৭) নিয়ন্ত্রণের কৌশলগত পার্থক্য :
উপনিবেশবাদের ক্ষেত্রে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এবং পরবর্তীকালে উপনিবেশের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সাধারণত এমন পরিস্থিতি দেখা যায় না। এক্ষেত্রে সামরিক অভিযানের দ্বারা অধিকৃত এলাকার ওপর প্রত্যক্ষ শাসন কায়েম করা হয়।
৮) উদাহরণগত পার্থক্য :
উপনিবেশিক আধিপত্য কায়েম হয়েছিল এমন কিছু উল্লেখযোগ্য দেশের নাম হলো : ভারত, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা, আলজেরিয়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ইউরোপীয় দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী শাসন কায়েম রেখেছিল।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক :
উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, উপনিবেশবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক খুবই গভীর। এই সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই উভয়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন,
১) উভয় মতবাদ নতুন নতুন দেশে উপনিবেশ স্থাপনে উৎসাহিত করে
২) উভয়ই মতবাদই উপনিবেশগুলিতে আর্থিকভাবে শাসন ও শোষণ কায়েম করে
৩) উপনিবেশগুলিতে ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই শেষ পর্যন্ত তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
---------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন