জাদুঘরের বিকাশ ও প্রকারভেদ আলোচনা করো
সুদূর অতীত কালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। যুগের অগ্রগতির সাথে সাথে অতীতকালের জাদুঘর গুলির বিবর্তন ও বিকাশ ঘটতে থাকে। বিকাশের বিভিন্ন ধারায় সেই প্রাচীন জাদুঘর গুলি আজ আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জাদুঘরের পরিণত হয়েছে।
জাদুঘরের বিকাশ
প্রাচীন জাদুঘর :
প্রাচীন জাদুঘর গুলোকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা যায়। ১) পঞ্চদশ শতকের পূর্বের জাদুঘর। ২) পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের জাদুঘর।
১) পঞ্চদশ শতকের পূর্বের জাদুঘর :
প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চদশ শতকের ইতালীয় নবজাগরণের শুরু পর্যন্ত সময়কালে যে সমস্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলোতে সর্বসাধারণের প্রবেশ অধিকার ছিলনা। এই সময়কার উল্লেখযোগ্য জাদুঘর গুলির মধ্যে মেসোপটেমিয়ার এননিগালডি - নান্না-র জাদুঘর বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। এটা পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘর।
এছাড়া এথেন্সের প্লেটোর জাদুঘর, এবং আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘরও এই সময়ের উল্লেখযোগ্য দুটি জাদুঘর।
২) পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের জাদুঘর :
এই সময় থেকে জাদুঘর গুলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকারের সুযোগ দেয়া হয়। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য জাদুঘর গুলি হল : ইতালির রোম শহরে অবস্থিত ক্যাপিটো লাইন মিউজিয়াম, ভার্টিকান মিউজিয়াম, ইংল্যান্ডে অবস্থিত রয়েল আরমারিস মিউজিয়াম (ইংল্যান্ডের প্রথম জাদুঘর), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলিয়াস আ্যাসমোলীয়ান মিউজিয়াম।
তবে মনে রাখতে হবে, এই জাদুঘর গুলি জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হলেও তাতে প্রবেশাধিকারের প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই জটিল। মিউজিয়ামে প্রবেশের জন্য সাধারণ মানুষকে (নিম্নবিত্ত শ্রেণির) কমপক্ষে দু সপ্তাহ আগে লিখিত আবেদন করতে হতো। এই আবেদন অধিকাংশ সময় গ্রাহ্য হতো না।
আধুনিক জাদুঘর :
সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকারের এই জটিল প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিতে চালু হয় আধুনিক জাদুঘর। এই জাদুঘর গুলিকে দুটি পর্বে ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্বের আধুনিক জাদুঘর :
এই পর্বের উল্লেখযোগ্য জাদুঘর গুলি হল
১) লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম (১৭৫৩)। ১৭৫৯ সালে এই জাদুঘরটি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেয়া হয়।
২) ফ্লোরেন্সের উফ্ফিজি গ্যালারি। এটি দর্শকদের দীর্ঘকাল অনুরোধের পর ১৭৬৫ সালে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খুলে দেয়া হয়।
৩) ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়াম। ১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় এই জাদুঘরটি জনগণের জন্য খুলে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্বের আধুনিক জাদুঘর :
ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে নতুন নতুন বহু জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই কারণে এই সময়কালকে জাদুঘরের যুগ (The Museum Age) বলে অভিহিত করা হয়।
এই পর্বের উল্লেখযোগ্য জাদুঘর গুলি হল :
১) আমেরিকার দ্যা আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগো (১৮৭৯),
২) কর্পোরান গ্যালারি অফ আর্ট (ওয়াশিংটন, ১৯০১)
৩) ডালাস মিউজিয়াম অফ আর্ট (১৯০৩)
৪) কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল (১৯২১)
৫) নিউইয়র্কের the মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট (১৯২৯)
মূলত ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী প্রদর্শনের পাশাপাশি সেগুলি নিয়ে গবেষণা করায় ছিল এই পর্বের মিউজিয়াম গুলির গড়ে তোলার অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও শিল্পের বিকাশ বিষয়ে আলোকপাত করা।
জাদুঘরের প্রকারভেদ
জাদুঘরের সংরক্ষিত বিভিন্ন বস্তুর ধরণের ভিত্তিতে জাদুঘরকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়।
১) বিশ্বকোষ জাদুঘর :
বিভিন্ন দেশের সবৃহৎ, বিশেষ করে জাতীয় জাদুঘরগুলোকে বিশ্বকোষ জাদুঘর বলে। এই জাদুঘরগুলিতে বিপুলসংখ্যক দর্শকের সমাগম হয় এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের বিপুল ও অসাধারণ সংগ্রহ থাকে। যেমন ব্রিটিশ মিউজিয়াম।
২) প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর :
এই ধরনের জাদুঘর গুলোতে কেবলমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সংগ্রহ সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। এই ধরনের জাদুঘর গুলি কখনো খোলা জায়গায় (উদাহরণ, এগরা অফ এথেন্স) আবার কখনো অট্টালিকার অভ্যন্তরে ( উদাহরণ, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম) অবস্থিত হয়।
৩) শিল্প জাদুঘর :
শিল্প জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসমলিয়ান জাদুঘর হল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিল্প জাদুঘর।
৪) ঐতিহাসিক গৃহ যাদুঘর :
কোন প্রাচীন ঐতিহাসিক গৃহ কে কেন্দ্র করে যে জাদুঘর গড়ে ওঠে তাকে ঐতিহাসিক গৃহ যাদুঘর বলে। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগে অবস্থিত হাজার দুয়ারী একটি ঐতিহাসিক গৃহ জাদুঘরের উদাহরণ।
৫) জীবন্ত জাদুঘর :
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচীন যুগের মানুষের জীবনযাত্রা কখনো নাটকের মাধ্যমে বা অন্য কোন কৃত্রিম উপায়ে দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয় যে মিউজিয়াম গুলোতে সেগুলোকে বলে জীবন্ত জাদুঘর। সুইডেনের ‘স্ক্যানসেন মিউজিয়াম’ ও বৃটেনের ‘কলোনিয়াল উইলিয়ামসবার্গ’ জীবন্ত জাদুঘরের উদাহরণ
৬) সমুদ্র জাদুঘর :
সমুদ্র জাদুঘর হল প্রাচীনকালের সমুদ্র জীবন সংক্রান্ত সংগ্রহশালা। প্রাচীনকালে সমুদ্রের সঙ্গে কোন মনুষ্য সমাজের সম্পর্ক কেমন ছিল তা এই জাদুঘরে তুলে ধরা হয়। ভার্জিনিয়ার মেরিনারস মিউজিয়াম ও সান ফ্রান্সিসকো র মেরিটাইম মিউজিয়াম এই ধরনের জাদুঘরের উদাহরণ ।
৭) সামরিক জাদুঘর :
এই ধরনের জাদুঘরে কোন দেশের সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধ সংক্রান্ত নানা নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। দ্য ন্যাশনাল ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ার মিউজিয়াম এবং কানাডিয়ান ওয়্যার মিউজিয়াম হল সামরিক জাদুঘরের উদাহরণ।
৮) প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর :
এই সমস্ত জাদুঘরে পৃথিবীর প্রাকৃতিক নিদর্শন গুলি সংগ্রহ সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। এইসব নিদর্শন এর মাধ্যমে জাদুঘর গুলি বিবর্তন জীব-বৈচিত্র প্রভৃতি বিষয়ে দর্শকদের শিক্ষাদান করে। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি হল প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
৯) বিজ্ঞান জাদুঘর :
বিজ্ঞান জাদুঘর হল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে নিদর্শন সংগ্রহ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনকারী মিউজিয়াম। শিকাগো মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি হল একটি বিজ্ঞান জাদুঘর।
১০) চলমান জাদুঘর :
যখন কোন চলমান যানের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ঐতিহাসিক বা দুর্লভ নিদর্শনসমূহ দর্শকদের সামনে প্রদর্শন করা হয় তখন তাকে চলমান জাদুঘর বলে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের সার্ধশতবর্ষে তৈরি করা ‘সংস্কৃতি এক্সপ্রেস’ হল একটি চলমান জাদুঘরের উদাহরণ।
১১) নেট জাদুঘর :
কোন কোন সংস্থা তাদের বিভিন্ন নিদর্শন গুলোর ছবি তুলে সেগুলোকে ইন্টারনেটে প্রকাশ করে জনসাধারণকে দেখানোর জন্য। এই ধরনের ওয়েবসাইট গুলোকে নেট জাদুঘর নামে অভিহিত করা হয়।
১২) জৈবপার ও বৃক্ষ বাগান :
জৈবপার্ক অর্থাৎ যেখানে বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি সহ অসংখ্য বৃক্ষের সংগ্রহ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় সেগুলোকে জৈবপার্ক ও বৃক্ষ বাগান নামে অভিহিত করা হয়। লন্ডন জু, শিকাগো বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং কলকাতার চিড়িয়াখানা এই ধরনের জাদুঘরের উদাহরণ।
এছাড়া ক্ষণস্থায়ী জাদুঘর বিশেষ জাদুঘর স্থানীয় জাদুঘর ব্যক্তিগত জাদুঘর ইত্যাদি নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে।
--------xx-------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন