ইতিহাস কী? পেশাদারি ইতিহাস বলতে কী বোঝ? অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য কী? পেশাদারি শাখা হিসাবে ইতিহাসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।
ইতিহাস কী :
সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল
ইতিহাস। ঐতিহাসিক ই. এইছ. কার-এর মতে, ইতিহাস থেকে যে সমস্ত সাধারণ সূত্র গড়ে ওঠে
সেগুলি মানুষের খুব কাজে লাগে। তাই বলা হয়, ইতিহাস হল মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের
ধারাবাহিক বিবরণ।
পেশাদারি ইতিহাস কী
পেশাদারি ইতিহাস হল ইতিহাসের
সেই শাখা যা ঘটনার সত্যতা ও বাস্তবতা বজায় রেখে, পক্ষপাতহীন ভাবে, সুসংবদ্ধ
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রচনা করা হয়।
I.
এই ইতিহাস প্রাথমিক উপাদানের উপর
নির্ভর করে যথেষ্ট যাচাই ও বিশ্লেষণ করে লেখা হয়। তাই এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
II.
মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,
সাংস্কৃতিক, ও ধর্মীয়জীবনসহ মানব সভ্যতার সমগ্র বিষয়ই পেশাদারি ইতিহাসের আলোচনার
বিষয় হয়ে থাকে।
পেশাদারি ও অপেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য
বিষয়
|
অপেশাদারি ইতিহাস
|
পেশাদারি ইতিহাস
|
|
১)
|
লিখন পদ্ধতি
|
এই ধরণের ইতিহাস
লেখার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ও পক্ষপাতিত্বের প্রভাব থাকে
|
যুক্তিনিষ্ঠ,
ভাবাবেগ বর্জিত, নিরপেক্ষ, সুসংবদ্ধ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই ইতিহাস লেখা হয়।
|
২)
|
ইতিহাসগত চেতনা
|
বুদ্ধিজীবীদের
ইতিহাসগত ভাবনা-চেতনা পুরণে এই ইতিহাসের উপাদানগুলি অক্ষম।
|
এক্ষেত্রে পেশাদারি
ইতিহাস খুবই কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে।
|
৩)
|
যুগোত্তীর্ণ
|
এই ইতিহাসের উপাদানগুলি
ইতিহাসের আকর হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যুগোত্তীর্ণ হতে পারে না।
|
এই ধরণের ইতিহাস
শুধুমাত্র বর্তমানের জ্ঞানভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করে না, ভবিষ্যতের চলার পথের দিশা দেখায়
|
৪)
|
সৃষ্ঠির রীতিনীতি
|
ইতিহাসের সৃষ্ঠি,
সৃষ্ঠির রীতিনীতি জানার ক্ষেত্রে এই ইতিহাসের বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই।
|
এক্ষেত্রে এই
ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
|
৫)
|
বিশ্বাসযোগ্যতা
|
এই ইতিহাসের নির্ভরযোগ্যতা
ও বিশ্বাসযোগ্যতা খুবই কম।
|
বৃত্তিমূলক শাখা
হিসাবে এই ইতিহাসের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি।
|
৬)
|
যাচাই ও বিশ্লেষণ
|
এখনে ঐতিহাসিক
তথ্য যাচাই ও বিশ্লেষণ না করেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়।
|
এক্ষেত্রে যাচাই
ও বিশ্লেষণ করেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়।
|
৭)
|
ধারাবাহিকতা ও কালানুক্রম
|
ধারাবাহিকতা ও
কালানুক্রম এখনে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
|
এখানে এই বিষয়টি
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যে-কোনো ঘটনার বর্ননার ক্ষেত্রে সেই ঘটনার সময়কাল উল্লেখ
করা।
|
৮)
|
অর্থনীতি
|
এই ধরণের ইতিহাসে
অর্থনীতি নিতান্তই গৌণ ব্যাপার।
|
মানবসমাজের একটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অর্থনীতি। তাই পেশাদারি ইতিহাস একে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়।
|
ইতিহাসের গুরুত্ব
প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিক
থুকিডিডিস ইতিহাসের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, অতীত কালে যা ঘটেছে তাঁর সঠিক জ্ঞান
ভবিষ্যতে প্রয়োজন আসবে, কারণ মানুষের কর্মকান্ডের সম্ভাব্যতার নিরিখে ভবিষ্যতেও
একই ধরণের ঘটনা পুনরায় সংঘটিত হবে। তাই, সমাজবিজ্ঞানের শাখা হিসাবে ইতিহাস খুবই
গুরুত্বপূর্ণ।
I.
অতীতের আয়না। ইতিহাস হল অতীতের আয়না। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব, তাদের বন্য বা অসভ্য
জীবন, তা থেকে ক্রমে সভ্যতায় পদার্পণ, সভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রগতি সবকিছুই আমরা
ইতিহাস থেকে জানতে পারি। ঐতিহাসিক বিউরি এবং র্যাংকের মত হল, “ঐতিহাসিকের কাজ হল
শুধুমাত্র অতীত পুনর্গঠন করা এবং অতীত ঘটনাগুলিকে পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে
উপস্থাপিত করা।
II.
জ্ঞানের বিকাশ। আমরা সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করে থাকি। তবে এদের
মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানের ভাণ্ডার হল ইতিহাস। মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের বা সমগ্র
কর্মকান্ডের আলোচনা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। ইতিহাসবিদ কলিংউড তাঁর The Idea of History’ গ্রন্থে লিখেছেন, ইতিহাসের সর্বপ্রধান গুরুত্ব
হল তা আমাদের জ্ঞানে৪র ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
III.
ধারাবাহিকতা। সুদূর অতীত থেকে মানব সভ্যতা নানা পর্ব অতিক্রম করে বর্তমান সময়ে এসে
পৌঁছেছে। ইতিহাস এই পর্বগুলির (যুগের) মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে যুগ ও ঘটনাকে
ধারাবাহিক করে তোলে। আমারা প্রাগৈতিহাসিক, প্রায়-ঐতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের
বিভিন্ন পর্ব অতিক্রম করে কিভাবে আধুনিক যুগে পৌঁছালাম তার ধারাবাহিক বিবরণ ইতিহাস
থেকেই জানা যায়।
IV.
ইতিহাস বর্তমান যুগের ভিত্তি। অতীতের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মানুষ বর্তমান সময়ে এসেছে। (তাই বলা যায়,
বর্তমান মানবজাতির মূল শিকড় ইতিহাসের সুদূর গভীরে গাথা রয়েছে।) সুতরাং বর্তমানকে
ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে একমাত্র ইতিহাসই সাহায্য করতে পারে। যেমন, বর্তমান ভারত
নানা ভাষা ও ধর্মের দেশ। ভাষা ও ধর্মের এই বিভিন্নতার ভিত্তি যে লুকিয়ে আছে ভারতের
সুপ্রাচীন অতীতে তা আমরা ইতিহাস থেকেই জানতে পারি।
V.
স্থিতিলীলতার গুরুত্ব। যে জাতির জীবন যত বেশি স্থিতিশীল তারা তত বেশি উন্নত। এই স্থিতিশীলতা ও
অগ্রগতির এই যে কার্যকারণ সম্পর্ক তা কোনো জাতির ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়।
VI.
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উন্নয়ন। কোনো শাসকের রাজনৈতিক কিম্বা প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলির বিশ্লেষণের মধ্যেই আছে
তার সাফল্য কিম্বা ব্যর্থতার অন্তর্নিহিত কারণ। বর্তমান শাসকরা ইতিহাস থেকে নেওয়া
বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে পারেন। (যেমন, আকবরের
রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ পরবর্তীকালের শাসকদের সাফল্যের
চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে।)
VII.
অর্থনৈতিক উন্নয়ন। মানব সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অর্থনীতি। কী ধরণের অর্থনীতি
রাষ্ট্র বা সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে সে বিষয়ে ইতিহাস সুস্পষ্ট ধারণা দিতে
পারে। যেমন, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ইত্যাদির পিছনে অর্থনৈতিক নীতির
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল যা অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে।
VIII.
ধর্মসহিষ্ণুতা। ইতিহাস মানুষের ধর্ম-জীবন নিয়েও আলোচনা করে। ইতিহাস থেকেই আমরা জানতে
পারি যে, স্ম্রাট অশোকের ধর্মবিজয় নীতি ও আকবরের ধর্মসহিষ্ণুতার নীতি জাতি ও
রাষ্ট্রকে আরও শক্তিশালী হতে সাহায্য করেছিল।
IX.
সাংস্কৃতিক অগ্রগতি। ইতিহাস জানতে সাহায্য করে যে, আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি অতীতের সংস্কৃতির
ধারাবাহিক বিবর্তনের পরিণাম।
X.
জাতিয়তাবোধের বিকাশ। নিজের দেশ ও জাতির প্রতি কোনো জনগোষ্ঠীর ভালোবাসার প্রকাশকে জাতীয়তাবাদ
বলে। ইতিহাস কোনো জাতিকে তার অতীত ঐতিহ্য ও মহত্ত্ব কিম্বা অন্য কোন দেশের
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের জাতীয়তাবোধে উদবুদ্ধ করতে পারে।
আমেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এভাবেই প্রভাবিত করেছে।
XI.
আত্মপ্রত্য্যের বিকাশ। ইতিহাস কোনো জাতির জীবনে আত্মপ্রত্যয়ের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। অতীতের
বিভিন্ন মানব জাতির যুগান্তকারী কর্মকান্ডের কথা মানুষ ইতিহাস থেকেই জানতে পারে।
ফলে তারা উপলব্ধি করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানুষও চেষ্টা করলে তেমন কাজ করা সম্ভব।
যেমন, মারাঠা জাতির অতীত কর্মকান্ড ও বিপুল শক্তির কথাই শিবাজীর নেতৃত্বে
মারাঠাদের মোঘলদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে সাহস যুগিয়েছিল।
XII.
দুর্যোগ সম্পর্কে সতর্কতা। বিভিন্ন
দুর্যোগের ফলে অতীতকালে বহু জনজাতির সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। যেমন ছিয়াত্তরের
মন্বন্তর। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণা করে দেখিয়েছেন, কীভাবে তা প্রতিরোধ
করা যেত। ইতিহাসের এই তথ্য পরবর্তী প্রজন্মের দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
XIII.
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে জ্ঞানলাভ। ইতিহাস বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আলোচনা করে। এই নীতির
বিশ্লেষণ কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সাহায্য করে থাকে। ভারতের পঞ্চশীল
নীতি পরবর্তী সময়ে তৃতীয় বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
মূল্যায়ন
মানবজাতির সমাজ, রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি সবকিছুই ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়। তাই এসব বিষয়
সম্পর্কে সার্বিক জ্ঞানলাভের জন্য ইতিহাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাস
থেকে শিক্ষা নিলে মানব সমাজ আরও সুন্দর ও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। যদিও মানুষ তা সবসময়
নেয় না। তাই হেগেল আক্ষেপ করে বলেছেন, “ইতিহাসের দূর্ভাগ্য যে, ইতিহাস থেকে কেউ
শিক্ষা নেয় না”।
---------*******---------
ধন্্য বাদ
উত্তরমুছুনVery helpful
উত্তরমুছুনvery well explanation
উত্তরমুছুন