উঃ
মৌখিক ঐতিহ্য কী?
মৌখিক ঐতিহ্য হল এমন এক সংস্কৃতিক ধারণা যা এক প্রজন্ম থেকে
অন্য প্রজন্মে লোকমুখে প্রচলিত হয়।
জান ভ্যানসিনা বলেছেন, মৌখিক
ঐতিহ্য হল এক ধরণের মৌখিক বার্তা যা কথা, গান প্রভৃতির
মাধ্যমে মুখে মুখে পূর্ববর্তী প্রজন্ম অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছায়।
Oral History Association – এর মতে, “অতীতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষের কন্ঠস্বর, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও চর্চা করাকেই মৌখিক ইতিহাস বা মৌখিক
ঐতিহ্য বলে”।
উদাহরণ –
১) প্রচীন গ্রিসের ইতিহাস, ২) নীলকরদের অত্যাচারের ইতিহাস, ৩) ক্ষুদিরামের ফাঁসি, উদবাস্তু ইতিহাস ইত্যাদি।
মৌখিক ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য
মৌখিক ঐতিহ্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল –
1)
সাক্ষাৎকার। মৌখিক ঐতিহ্যের একটি
প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এক ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য
ব্যক্তি মৌখিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করে। বর্তমানে অবশ্য রেকর্ড করার যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার
করা হয়।
2)
অলিখিত। মৌখিক ঐতিহ্য হল এক
অলিখিত সাংস্কৃতিক বিষয়। নথিপত্র ছাড়াই লোকমুখে প্রচারিত ঘটনাই এখানে গ্রহন করা হয়।
3)
সংরক্ষণ। মৌখিক ঐতিহ্যের
অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সংরক্ষণ। সুপ্রাচীন অতীতের কোনো ঘটনা মুখে মুখে প্রচারিত হওয়ার পর সেগুলি
সংরক্ষনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
4)
উৎস। পণ্ডিত কারাডজিক
সর্বপ্রথম মৌখিক ঐতিহ্য অধ্যায়নের ক্ষেত্ররূপে তার উৎসের সন্ধান দেন। তাঁর মতে এই উৎস হল
লোকগাথা।
5)
বিষয়। প্রাচীন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়
জীবনের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে মৌখিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
গুরুত্ব বা তাৎপর্য
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মৌখিক
ঐতিহ্যের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। গুরুত্বগুলি হল –
I.
আদিম সমাজে গুরুত্ব। লিখিত ইতিহাসের ধারা
শুরু হওয়ার আগে আদিম মানুষের কাছে অতীতের তথ্য সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম ছিল মৌখিক
ইতিহাস বা ঐতিহ্য। যেমন, গ্রিক লেখক থুকিডিডিসের ‘পেলোপনেসীয় যুদ্ধের ইতিহাস’ মৌখিক ঐতিহ্যের উপর
ভিত্তি করেই লেখা।
II.
প্রাথমিক উপাদান। কোন ঘটনার ইতিহাস
যখন প্রথম লেখা হয়, তখন তার প্রাথমিক উপাদান বিশেষ পাওয়া যায়
না।
সেক্ষেত্রে মৌখিক ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
III.
নিম্নবর্গের ইতিহাস। অনেক সময়
নিম্নবর্গের মানুষদের কার্যক্রমের কোন লিখিত নথি থাকে না। এক্ষেত্রে তাদের ইতিহাস
জানতে মৌখিক ঐতিহ্য যেমন - মুখের কথা, প্রবাদ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদির সাহায্য নিতে হয়।
IV.
যথার্থ তথ্য সরবরাহ। সাম্রাজ্যবাদি
ঐতিহাসিকরা অনেক সময় যথার্থ ইতিহাসকে আড়াল করার চেষ্টা করে। কিন্তু মৌখিক ঐতিহ্যের
মাধ্যমে যথার্থ ইতিহাস জনসমাজের মধ্যে প্রচলিত থাকে। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর
এই তথ্য প্রকৃত ইতিহাস লিখতে সাহায্য করে।
V.
মতবিরোধ মেটানো। ইতিহাস রচনায় লিখিত
বিবরণ ও লোকাচারের মধ্যে যদি বিরোধ তৈরি হয় তবে তা মেটানোর জন্য মৌখিক ঐতিহ্যের
সাহায্য নেওয়া হয়।
সমালোচনা বা মূল্যায়ন
এতদসত্তেও মৌখিক ঐতিহ্য কখনোই
সমালোচনার উর্দ্ধে নয় –
A. ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ। মৌখিক ঐতিহ্য লোকমুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে
প্রচারিত হয়। তাই এতে অনেক সময় ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।
B.
ধারাবাহিকতার অভাব। বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন সময়ে মৌখিক ঐতিহ্যের সুবাদে
কোনো কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কাহিনির ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় না।
C.
নিজস্ব মতাদর্শের অনুপ্রবেশ। মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্যে বক্তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা আবেগ-কল্পনা কিম্বা নিজস্ব
মতাদর্শের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা থাকে।
সুতরাং মৌখিক ঐতিহ্য থেকে
ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। কিন্তু যখন প্রকৃত লিখিত
তথ্যের অভাব থাকে তখন মৌখিক ঐতিহ্যই প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। তাই কানাডার সুপ্রিমকোর্ট এক
ঐতিহাসিক রায়ে বলেন – মৌখিক ইতিহাস বা ঐতিহ্য ইতিহাসের লিখিত তথ্যের মতোই সমান
গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন