১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ সংক্ষেপে লেখো।
![]() |
মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ |
ঔপনিবেশিক শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক শোষণ। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই শোষণ তারা নির্মমভাবে চালিয়েছে। ফলে সমাজের নানা স্তরের মানুষ আর্থিক দিক থেকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ :
অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরী মতে, ভারতের সাধারণ মানুষ জমি ও সম্পত্তির অধিকার হারিয়ে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের যোগদান করেছিল।
১) সম্পদ লুণ্ঠন :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে ‘পলাশীর লুণ্ঠন’ দিয়ে শুরু করে ভারতের সম্পদ লুণ্ঠনের আগ্রাসী প্রক্রিয়া। এরপর প্রায় একশো বছর ধরে তারা দেশের সম্পদ নানা কৌশলে লুট করে এবং ইংল্যান্ডে পাচার করে।
২) কুটির শিল্পের ধ্বংস সাধন :
অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। এই শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং শিল্পকণ্য বিক্রি করার জন্য ভারতীয়দের ঘাড়ে বৈষম্য মূলক শুল্কনীতি চাপায়। ফলে, ভারতীয় পণ্যের দাম বাড়ে এবং ইংল্যান্ডের পণ্যের দাম কমে যায়। পরিনাম ভারতীয় কুটির শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়।
৩) ভারতীয় কৃষির ধ্বংস সাধন :
ইংল্যান্ডের শিল্প কারখানায় সস্তায় কৃষি পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য ইংরেজ সরকার বৈষম্যমূলক মাশুল নীতি গ্রহণ করে। দেশের অভ্যন্তর থেকে বন্দর মুখী কৃষি পণ্য যাতায়াতে মাশুল কম ধার্য করা হয়। ফলে ভারতীয় কৃষি পণ্য সহজে বন্দর মারফত ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর সুবিধা হয়।
এছাড়া, ইংল্যান্ডের শিল্পের উন্নতির দিকে লক্ষ্য রেখে ভারতের কৃষি নীতি গ্রহণ করার ফলে ভারতীয় কৃষি এবং তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গ্রামীন অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
৪) বেকারত্ব বৃদ্ধি :
একের পর এক দেশীয় রাজ্য দখল করার ফলে এইসব রাজ্যের রাজকর্মচারী এবং তাদের প্রশাসনের বহু কর্মচারী কাজ হারায়।
ইংল্যান্ডের স্বার্থে ভারতীয় কুটির শিল্প ধ্বংস হওয়ার ফলে অসংখ্য তাঁতি কারিগর কাজ হারায়।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝা যায় ঐতিহাসিক জন কে-র মন্তব্যে। তিনি লিখেছেন, এই সময় অনেক সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারা রাতের অন্ধকারে রক্ষা করতে বাধ্য হয়।
৫) দেশীয় ভাষায় শিক্ষিত ব্যক্তির বঞ্চনা :
ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা দখলের পর ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দেশীয় ভাষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
৬) উচ্চহারে ভূমি রাজস্ব ধার্য :
চিরস্থায়ী, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি ইত্যাদির ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (সরকার) কৃষকদের উপর উচ্চ হারে কর বাসায়। ফলে কৃষকরা মহাজনের ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে তারা ভূমিহীন হতে থাকে।
৭) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব :
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সহ এই সমস্ত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে বহু পুরনো জমিদার জমিদারি হারায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্তর্গত ‘সূর্যাস্ত আইন’ নতুন জমিদারদের অসন্তোষের কারণ হয়ে ওঠে।
মন্তব্য :
এইভাবে নানান নীতি ও কৌশল অবলম্বন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ইংরেজ সরকার) ভারতের অর্থনীতিতে বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। উল্টোদিকে হিরে এবং গণ্ডির মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে। দাদাভাই নওরোজি, এই প্রক্রিয়াকে ‘ড্রেন অফ ওয়েলথ’ বা ‘সম্পদের নিঃসরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। পি জে মার্শালের মতে, এই আর্থিক লুটতরাজই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের একটি বড় কারণ।
------------xx-----------
এই প্রশ্নটি অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে লেখো।
- ভারতীয়দের উপর অর্থনৈতিক শোষণ কিভাবে মহাবিদ্রোহের পটভূমি তৈরি করেছিল ব্যাখ্যা করো।
- ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক লুটতরাজ মহাবিদ্রোহকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে —মন্তব্যটি ব্যাখ্যা করো।
এই অধ্যায়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন :
- মহাবিদ্রোহের রাজনৈতিক কারণ কী ছিল?
- মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণ কী ছিল?
- মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণ সংক্ষেপে লেখো।
- মহাবিদ্রোহের পেছনে ধর্মীয় কারণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
- মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কি ছিল? এই কারণ কীভাবে মহাবিদ্রোহকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল?
- মহাবিদ্রোহের সামরিক কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন