১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি আলোচনা করো। (মান - ৪)
![]() |
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি |
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামতগুলো হল —
১) সিপাহী বিদ্রোহ :
অধিকাংশ ইংরেজ ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জন লরেন্স, চার্লস রেকস, টি আর হোমস্ প্রমূখ। তাঁদের যুক্তি হলো, এই বিদ্রোহের সূচনা, পরিচালনা ও প্রসারে সিপাহীরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এবং বিদ্রোহ শেষে তারাই সবচেয়ে বেশি শাস্তি ভোগ করেছেন।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অভিমত :
তদানীন্তন ভারত সচিব আর্ল স্ট্যানলি তাঁর প্রতিবেদনে এই বিদ্রোহকে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।
- ঐতিহাসিক চার্লস রেকস তাঁর গ্রন্থে (Notes on the revolt in the North Western province of India) এই বিদ্রোহকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোভী সিপাহীদের বেআইনি অভ্যুত্থান বলে মন্তব্য করেছেন।
- ঐতিহাসিক টি আর হোমসের মতে, সিপাহীদের এই বিদ্রোহ ছিল আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সংঘাত।
ভারতীয় ঐতিহাসিকদের অভিমত :
একইসঙ্গে সমকালীন বিশিষ্ট ভারতীয় বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও এই বিদ্রোহকে সিপাহীদের সামরিক বিদ্রোহ হিসেবেই নিন্দা করেছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি, সৈয়দ আহমেদ খান, রাজনারায়ণ বসু প্রমূখ।
২) জাতীয় বিদ্রোহ :
অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের যুক্তি হল—
জাতীয় বিদ্রোহ বলার কারণ :
- এই বিদ্রোহে সিপাহীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও সব দেশীয় সিপাহী এই বিদ্রোহে যোগদান করেনি। অধিকাংশ সিপাহী বিদ্রোহ দমনে অংশগ্রহণ করেছে।
- অন্যদিকে দেশীয় রাজন্যবর্গ, সাধারণ কৃষক, কারিগর, দিনমজুর এই বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
- সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ দিল্লি ঘোষণা ও আজমগড় ঘোষণার মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ থেকে ইংরেজদের বিতরণের আহ্বান জানান।
- বিরজিস কাদির তাঁর ইস্তেহারে ইংরেজমুক্ত ভারত গঠনের ডাক দেয়া হয়।
ঐতিহাসিকদের মতামত : পক্ষে —
- অধ্যাপক সুপ্রকাশ রায় দেখিয়েছেন, এই বিদ্রোহে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের চেয়েও বেশি কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল।
- অধ্যাপক রঞ্জিত গুহ এই বিদ্রোহকে নিম্নবর্গের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন।
- ডক্টর শশীভূষণ চৌধুরী মতে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করে।
ঐতিহাসিকদের মতামত : বিপক্ষে —
অন্যদিকে ঐতিহাসিক টমাস মেটক্যাফ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমূখের যুক্তি হল :
- প্রথমত : এই বিদ্রোহ কোনো কোনো সময় সিপাহী বিদ্রোহকে ছাপিয়ে গেলেও তা জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
- দ্বিতীয়ত : কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব, ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, সীমিত সংখ্যক জমিদার ও দেশীয় রাজন্যবর্গের অংশগ্রহণ, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিরোধিতা এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহে পরিণত হতে দেয়নি।
৩) প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম :
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর ‘The Indian war of independence’ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলার কারণ :
সাভারকর তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন—
- ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে সামনে রেখে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই লড়াই করেছিলেন।
- এই বিদ্রোহ আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, গোপন বৈঠক, এবং নানা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এগুলো হয়েছিল।
- প্রায় সমগ্র ভারতব্যাপী ব্যাপক জনসাধারণ বিদেশিদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতামত : পক্ষে —
- অধ্যাপক সুশোভন সরকার ইতালির কারবোনারি বিদ্রোহ ও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেনীয় জুন্টা আন্দোলন এর সঙ্গে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের তুলনা করে একে ভারতের মুক্ত যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
- অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় হিন্দু মুসলমানের মিলিত এই অভ্যুত্থানকে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন বলেছেন।
- ঐতিহাসিক জাস্টিন ম্যাকার্থি তাঁর ‘A History of Our Own Times’ গ্রন্থে লিখেছেন, একসময় সিপাহী বিদ্রোহ জাতীয় ও ধর্ম যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল।
- দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এবং বিরিজিস কাদিরের ঘোষণা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত দেয়।
ঐতিহাসিকদের মতামত : পক্ষে —
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে যাঁরা ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলতে অস্বীকার করেছেন, মূলত তাঁরাই এবং একই যুক্তিতে এই বিদ্রোহকে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলতে রাজি নন। রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘History of the Freedom Movement in India’ (Vol.1) গ্রন্থে বলেছেন, ১৮৫৭ সালে সংঘটিত তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ—না প্রথম, না জাতীয়, এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়।
৪) গণবিদ্রোহ :
ঐতিহাসিকদের মতামত : পক্ষে—
উত্তর ও মধ্য ভারতে, বিশেষ করে লখনৌ, অযোধ্যা, মুজাফফরনগর, সাহারানপুর প্রভৃতি এলাকাতে জনসাধারণই প্রথম বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেন এবং সিপাহীদের অংশগ্রহণে বাধ্য করেন।
- টি আর হোমসের হিসাব অনুযায়ী এই সময় শুধুমাত্র অযোধ্যায় ১.৫ লক্ষ বিদ্রোহী মারা যায়, যার মধ্যে সিপাহির সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ হাজার।
- জে বি নর্টন, জি বি ম্যালেসন, জন উইলিয়াম কে, গৌতম ভদ্র প্রমূখ ঐতিহাসিকদের মতে, এই বিদ্রোহকে সফল করতে যেভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে ভারতের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সামিল হয়েছিল তা একটি গণমুখী আন্দোলনের এই প্রতিচ্ছবি।
অর্থাৎ অভূতপূর্ব জনসমর্থন লাভ এই বিদ্রোহকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল।
ঐতিহাসিকদের মতামত : বিপক্ষে—
কিন্তু, কিশোরী চাঁদ মিত্র, দুর্গা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখের মতে, এই বিদ্রোহে গণবিদ্রোহের আবশ্যিক উপাদান, যেমন আপামর জনগণের অংশগ্রহণ, নেতাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ইত্যাদির একান্ত অভাব ছিল।
৫) সামন্ত বিদ্রোহ :
ঐতিহাসিকদের মতামত : পক্ষে—
বিদ্রোহের উদ্দেশ্য, ঘটনা প্রবাহ, নেতৃত্ব, অংশগ্রহণ ও পরিণতির দিক থেকে বিচার করে অনেক ইতিহাসিক ও গবেষক এই বিদ্রোহকে ‘সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া’ বলে বর্ণনা করেছেন।
- ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন, রজনীপাম দত্ত, পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এই মতের সমর্থক।
- বিদ্রোহের নেতৃত্ব সামন্ত শাসকদের হাতে থাকায় ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে ‘ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত ও মৃতপ্রায় সামন্তদের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করেছেন।
ঐতিহাসিকদের মতামত : বিপক্ষে—
কিন্তু, অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বক্তব্য অস্বীকার করেন। তার যুক্তি হলো,
- অযোধ্যার বাইরে অধিকাংশ জমিদারি ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন।
- অধিকাংশ সামন্ত রাজা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেনি।
- তাই এই বিদ্রোহকে কোনভাবেই সামন্ত বিদ্রোহ বলা যুক্তিযুক্ত নয়।
উপসংহার :
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ দেশীয় সিপাহীরা শুরু করলেও অচিরেই তার চরিত্র বা প্রকৃতি পাল্টে যায়। দ্রুত এই বিদ্রোহ ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বা কারো কারো মতে, ‘গণবিদ্রোহ’ রূপ লাভ করে। একটা পর্যায়ে এসে ‘ইংরেজ-মুক্ত ভারত গঠনের ঘোষণা’ আসে, যা ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা’ বলে অভিহিত করাই যায়। প্রসঙ্গত, ডক্টর সুশোভন সরকারের উক্তি উদ্ধৃত করে বলা যায়, “যারা ‘মারাঠা জাতীয়তাবাদ’, ‘রাজপুত জাতীয়তাবাদ’ প্রভৃতির কথা বলে গর্ব অনুভব করেন, তারা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলতে দ্বিধাগ্রস্ত কেন, তা প্রকৃতই বুদ্ধির অদম্য।”
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এই টানাপড়েনকে সামনে রেখে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ‘মহাবিদ্রোহ’ নামে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন।
------------xx-----------
এই প্রশ্নটিই অন্য যেভাবে আসতে পারে :
- ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
- ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে কি জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায়?
- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কতটা গণ বিদ্রোহ ছিল বলে মনে হয়।
- ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ বিরোধী মহাবিদ্রোহকে ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলা কতটা যুক্তিযুক্ত?
মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে আরও কিছু প্রশ্ন :
- ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায় কি?
- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কেন?
- ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ফলাফল আলোচনা করো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন