অথবা,
‘গ্যারান্টি প্রথা’ কী? রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কী ছিল? ভারতের অর্থনীতিতে রেলপথের কী প্রভাব পড়েছিল?
গ্যারান্টি প্রথা।
ভারতে ১৮৩২ সাল থেকে রেলপথ স্থাপনের
প্রস্তাব উঠতে থাকে। ১৮৫৩ সালে লর্ড ডালহৌসি সর্বপ্রথম বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ
স্থাপন করেন। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলিকে ভারতে রেলপথ স্থাপনে উৎসাহিত করার জন্য সরকার এই
সময় কয়েকটি বিষয়ে গ্যারান্টি বা প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিনামূল্যে জমিদান ও কোম্পানিকে বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর ৫ শতাংশ সুদ
প্রদান।
এই প্রতিশ্রুতিই ‘গ্যারান্টি প্রথা’ নামে
পরিচিত।
রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য / কারণ।
ভারতে রেলপথ স্থাপনে ইংরেজদের বিভিন্ন
সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। এই উদ্দেশ্যগুলির মধ্যেই রয়েছে রেলপথ গড়ে তোলার
অন্তর্নিহিত কারণ। উদ্দেশ্যগুলি হল –
১) অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য –
1) ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট কারখানাগুলিতে ভারতের কাঁচামাল সহজে ও
সুলভে বন্দরে নিয়ে যাওয়া।
2) ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দ্রুত ভারতের সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া।
3) শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের হাতে জমা উদবৃত্ত পুঁজি রেলপথ সহ
অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে লগ্নির ব্যবস্থা করা।
4) ভারতবর্ষে ইংরেজদের কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা।
২) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য –
A. সুবিশাল ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন
করা
B. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন সু-প্রতিষ্ঠিত করা।
C. প্রশাসনিক কাজের দ্রুত তদারকি করা।
৩) সামরিক উদ্দেশ্য –
I.
ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ দমনের
উদ্দেশ্যে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানো।
II.
বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা।
III.
সেনাবাহিনির কাছে দ্রুত খাদ্যরসদ ও
অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো।
৪) বিপর্যয় মোকাবিলা –
ঔপনিবেশিক ভারতে দুর্ভিক্ষ সহ নানা
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল নিয়োমিত ঘটনা। এই সব বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য উপদ্রুত এলাকায়
দ্রুত ত্রাণ ও খাদ্য পৌছানোর জন্য রেল যোগাযোগ অপরিহার্য ছিল।
উপসংহার
সুগত বসু ও আয়েশা জালাল তাঁদের
‘Modern South Asia’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন,
ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ভারতে রেলপথ স্থাপনের কর্মকান্ড
গ্রহন করা হয়েছিল। অধ্যাপক জে.এম.হার্ড যথার্থই বলেছেন, ‘এর পিছনে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যই
ছিল, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই’।
রেলপথের ফলাফল / প্রভাব
ডঃ বিপান চন্দ্র বলেছেন, ‘ভারতে রেলপথের
প্রবর্তন ভারতীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরবর্তনের সূচনা
করে’। এই পরিবর্তনের সদর্থক ও নঞর্থক দুটো দিক লক্ষ্য করা যায়।
সদর্থক প্রভাব
1. প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা। রেলপথ প্রতিষ্ঠার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায়
বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে।
2. পরিবহণের উন্নতি। রেল ব্যবস্থার প্রসারের ফলে ভারতে মানুষ ও পণ্য পরিবহণেও বৈপ্লবিক
পরিবর্তন আসে। ফলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা অনেক সহজ হয়।
3. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় কৃষিপণ্যের প্রবেশ ঘটে। ফলে, কৃষির
উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়ে।
4. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি। রেলপথের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
ফলে, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও বৃদ্ধি পায়।
5. রপ্তানি বৃদ্ধি। রেলের মাধ্যমে স্বল্পব্যয়ে এবং দ্রত কাঁচামাল বন্দরে পৌঁছে দেওয়া যেত। সেখান
থেকে সহজে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে যেত। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৬২-১৯২৮ সালের মধ্যে
রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।
6. আমদানি বৃদ্ধি। একই কারণে ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত শিল্পপণ্য সহজেই দেশের বাজারে
চলে আসত। তাই ১৮৬২-১৯২৮ সালের মধ্যে আমদানি বাণিজ্য ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়।
7. শিল্প স্থাপন।
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, ‘The railway system will become, in India, truly
the forerunner of modern industry.’( ‘রেলপথ ভারতে আধুনিক
শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে’।) বাস্তবক্ষেত্রে রেলপথ কাঁচামালের যোগান ও
উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে আধুনিক শিল্পের বিকাশে সাহায্য করেছিল।
8. কর্মসংস্থান।
রেলপথ নির্মান, রেলকারখানা ও পরিবহণের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হয়। ১৮৯৫
সালের হিসাব অনুযায়ী রেলে নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৩ হাজার।
9. জাতীয় ঐক্য। রেল
ব্যবস্থার সূত্রে ভাষা, ধর্ম ও গোষ্ঠীগত বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দেশবাসি পরস্পরের
মধ্যে যোগাযোগ ও মতামত আদানপ্রদান করতে সক্ষম হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য
ও জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে।
কুপ্রভাব বা নেতিবাচক প্রভাব।
তবে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা রেল
ব্যবস্থাকে সুনজরে দেখেননি। তাঁদের নজরে বেশ কিছু নেতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে। যেমন –
1) সম্পদের বহির্গমন। রেলপথ নির্মানে গ্যারান্টি প্রথার কারণে বার্ষিক ৫% হারে সুদ এবং সেই
সঙ্গে মুনাফা ধরলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে।
2) ভারীশিল্পে অনগ্রসরতা। রেলের যাবতীয় যন্ত্রাংশ ইংল্যান্ড থেকে আনা হত। এবিষয়ে এখানে কোন ভারীশিল্প
গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
3) কর্মসংস্থানে বৈষম্য। রেলকে কেন্দ্র করে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হলেও তার অধিকাংশ পদে
ইউরোপীয়দেরই নিয়োগ করা হত। রেলে উচ্চপদ্গুলিতে ভারতীয় নিয়োগের হার ছিল মাত্র ১০
শতাংশ।
4) দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যে অবক্ষয়। রেলের মাধ্যমে বিলাতি শিল্প-পণ্য ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশীয় পণ্যগুলি
অসম প্রতিযোগীতার স্মমুখীন হয়। দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য মার খায়।
5) বৈষম্যমূলক রেল মাশুল। পণ্য পরিবহণের
ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ভারতীয়দের বেশি মাশুল দিতে হত। ফলে দেশীয় ব্যাবসায়ীরা
ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
6) দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব। রেলপথের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশষ্যও বিদেশে
রপ্তানি হতে শুরু করে। ফলে ভারতে খাদ্যশষ্যের অভাব দেখা দেয়। পরিণামে ঘনঘন দুর্ভিক্ষ হতে
শুরু করে।
7) অন্যান্য পরিবহণের ক্ষতি। রেলপথে পরিবহণ
বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য পরবহণ মাধ্যমগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই মাধ্যমে নিযুক্ত শ্রমিকরা
অনেকেই বেকার হয়ে পড়ে।
8) শাসনের ফাঁস কঠিন। ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতার সামান্য সম্ভাবনা দেখ দিলেই রেলপথে সেনা পাঠিয়ে
তা দমন করা সহজ হয়ে যায়। ফলে শাসনের ফাঁস আরও কঠিন হয়। ঐতিহাসিক বুকানন বলেছেন, ‘স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রামগুলিকে এতদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের রেল সেই বর্ম ভেদ কর গ্রামজীবনের রক্ত শোষণ শুরু করে দেয়’।
মূল্যায়ন / মন্তব্য।
সার্বিক বিচারে বলা যায়, ১) ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই রেলপথ স্থাপন করেছিল। ২) এর ফলে ভারতীয়
জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছিল যথেষ্ট। ৩) তবে স্বাধীনতার পর এই রেলপথের মাধ্যমে ভারত
শিল্পায়নের পথেই অগ্রসর হয়।
Very nice👏. It's helpful to me
উত্তরমুছুনThis is very helpfully answer
উত্তরমুছুন