জোট নিরপেক্ষ নীতির প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করো। এর মূল নীতিগুলি উল্লেখ করো। এই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করো।
জোটনিরপেক্ষ নীতির পটভূমি ব্যাখ্যা করো। এর মূল নীতিগুলি উল্লেখ করো। এই নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন করো।
জোটনিরপেক্ষ নীতির পটভূমি মূলনীতি ও প্রয়োগে ভারতের ভূমিকা |
জোটনিরপেক্ষ নীতির পটভূমি:
১) বিশ্ব দুটি সামরিক জোটে বিভক্ত হওয়া :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে প্রায় সমগ্র বিশ্ব পরস্পর বিরোধী দুটি রাষ্ট্রজোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী জোট এবং অন্যটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সাম্যবাদী জোট।
২) সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা :
কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ এই দুই জোট থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও নতুন পাওয়া স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য চেষ্টা করে। ওই দুই রাষ্ট্রজোটে যুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। এই নীতিকে ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি’ বলে।
এই জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে যে আন্দোলনের সূচনা হয় তা ‘জোটনিরপেক্ষ (নির্জোট) আন্দোলন’ নামে পরিচিতি।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য :
ক) জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি :
১৯৫৪ সালের ২৯ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে পাঁচটি নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এই নীতিগুলি ‘পঞ্চশীল নীতি’ নামে পরিচিত।
১) পরস্পরের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো,
২) একে অপরকে আক্রমণ না করা,
৩) পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা,
৪) সমমর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পরিক সাহায্য দান করা,
৫) শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি অবস্থান করা।
১৯৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলনে এই পাঁচটি মূলনীতির সঙ্গে আরো পাঁচটি নীতি যুক্ত হয়ে ‘দশশীল নীতি’ গ্রহণ করা হয়। এই দশটি নীতি হলো জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি।
খ) জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য :
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি কার্যকর করাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
১) বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করা,
২) উপনিবেশ ও বর্ণবৈষম্যের বিরোধিতা করা,
৩) প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটানো,
৪) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সামরিক শক্তি ও জঙ্গিবাদীতার পরিবর্তে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা,
৫) কোন রাষ্ট্রের প্রতি ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ বা আক্রমণ না করা,
৬) পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতা ও সার্থরক্ষার ব্যবস্থা করা,
৭) মানবতা, মূল্যবোধ ও ন্যায়নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আন্তর্জাতিকতাবোধ ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি করা,
৮) সকল দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে স্বীকৃতি দেওয়া,
৯) ছোট বা বড় — সমস্ত জাতির সমান অধিকারের স্বীকৃতি জানানো।
১০) মৌলিক অধিকার ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা :
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারত ও তার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ক) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া :
১) কোরিয়া সংকট সমাধান : ১৯৫০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী বন্দী বিনিময় সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
২) ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান : ১৯৫৪ সালে জেনেভা সম্মেলনে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং ভিয়েতনামি জনগণের পক্ষে ভারতের অবস্থান ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধানে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছিল।
৩) রাষ্ট্রসঙ্ঘের চীনের সদস্যপদ : সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৯ সালে চিনে সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মার্কিনজোট তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারতের জোরালো সমর্থনে চিন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য পদ লাভ করে।
খ) পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকা :
১) মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক জোট : ১৯৫০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপনের উদ্দেশ্যে সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তি স্বাক্ষর করলে ভারত তা অগ্রাহ্য করে।
২) পশ্চিম এশিয়ার মুক্তি সংগ্রাম : পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে নির্জোট আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারত জোরালো সমর্থন করে।
৩) সুয়েজ সংকট সমাধান : ১৯৫৬ সালে মিশরের উপর ইংরেজ, ফরাসি ও ইসরাইল আক্রমণ করলে সুয়েজ সংকট সৃষ্টি হয়। নির্জোট আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারত এই আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। অবশেষে জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে।
৪) কঙ্গো ও আলজেরিয়ার সংকট : এছাড়া কঙ্গোকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গ) তৃতীয় বিশ্বে নেতৃত্ব দান :
এইভাবে একের পর এক জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানকল্পে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাকে তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বের পদে তুলে আনে। এই পদে থেকেই ভারত ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত আক্রমণের বিরোধিতা করে।
ভারতের ভূমিকার মূল্যায়ন :
সুতরাং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে, ভারত ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি। সেদিক থেকে বিচার করলে এই ঘটনা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একটা ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
----------xx--------
বিকল্প প্রশ্ন :
আরও প্রশ্ন দেখো :
Ami "জোটনিরপেক্ষ নীতি কী? এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য"প্রশ্ন টি কোথায় পাবো
উত্তরমুছুনSir ai questions tr ans pala khub valo hoto...
উত্তরমুছুন