চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে কীভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
অথবা,
চিনে কিভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে? চিনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাক্ষেত্রে এর কী প্রভাব পড়ে?
অথবা,
চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের কারণ ( পটভূমি ) ব্যাখ্যা কর। এর প্রভাব আলোচনা কর।
চিন ও পাশ্চাত্য শিক্ষা :
ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চিন ( বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ছাড়া ) বড় ধরণের কোনো বৈদেশিক সভ্যতা-সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয় নি। ফলে চিনের সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি --- সবকিছুই অন্তর্মুখী ও পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ( বুদ্ধিজীবীদের উদ্ভবের ) কারণ :
যে সমস্ত কারনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও আধুনিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় তা নিন্মরূপ :
- জাপানের কাছে পরাজয়ে : ১৮৯৪-৯৫ সালের যুদ্ধে ছোট্ট রাষ্ট্র জাপানের কাছে পরাজয়ের ফলে তারা বুঝতে পারে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ছাড়া চিনের অগ্রগতি সম্ভব নয়। ফলে চিনের বহু স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী পাশ্চাত্য শিক্ষাকে স্বাগত জানায়। আর এরই সূত্র ধরে চিনে ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।
- বিদেশী ভাষা শিক্ষা : ১৮৬২ সালে চিনে সর্বপ্রথম বিদেশী ভাষা শিক্ষার কলেজ স্থাপিত হয়। নাম 'তুং ওয়েন কুয়ান'। এই কলেজে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, জার্মান ভাষা সহ পাশ্চাত্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৬৩-৬৬ সালের মধ্যে সাংহাই, ক্যান্টন, ফুচাও প্রভৃতি শহরে এই ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে ১৮৯০ সালের মধ্যে চিনে পাশ্চাত্যের আদর্শ ও ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে পড়ে।
- মিশনারি উদ্যোগ : খ্রিষ্টান মিশনারি রবার্ট মরিসন ১৮০৫ সালে চিনে আসেন এবং ১৮৩০ সালে আমেরিকান মিশনারি এলিজা কোলম্যান চিনে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে টি. রিচার্ড, ইয়াং জে. অ্যালেন, এ পি মার্টিন প্রমুখ মিশনারি চিনে এসে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে কাজ করেন।
- কাং ইউ ওয়ে-র উদ্যোগ : অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় দর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শের অনুরাগী হয়ে ওঠেন কাং ইউ ওয়ে। তিনি টি রিচার্ড, ইয়ং জে অ্যালেন ও অন্যান্য মিশনারিদের লেখার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁদের সঙ্গে চিনে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের জন্য কাজে নেমে পড়েন।
- মাঞ্চু সরকারের ভূমিকা : ১৯০১ সালে মাঞ্চু সরকার শিক্ষা সংস্কারের ওপর জোর দেন। ১৯০৯ সালের মধ্যে চিনে লক্ষাধিক আধুনিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে মেধাবী ছাত্রদের জাপান এবং পাশ্চাত্য দেশগিলিতে আধুনিক শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়।
- পাশ্চাত্য গ্রন্থের অনুবাদ : এই সময় চিনা ভাষাকে সরলীকরণ করেন হু-শী, চেন তু-সিউ প্রমুখ ব্যক্তি। শুরু করেন সরলভাষায় পত্রিকা প্রকাশ ও পুস্তক রচনা। পাশ্চাত্যের বহু মূল্যবান গ্রন্থ চিনা ভাষায় অনুবাদ শুরু হয়। এই সমস্ত গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে সমাজে এক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় যাদের অনেকেই বুদ্ধিজীবী হিসাবে খ্যাতিলাভ করে।
এইভাবে চিনে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে, এবং সেই সূত্রে এক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জন্ম হয়। আর এদের নেতৃত্বেই বিংশ শতকে চিনে প্রকৃত বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ( বুদ্ধিজীবীদের প্রভাব ) :
- প্রথমত : ১৮৯৮ সালে কাং ইউ ওয়ে-র নেতৃত্বে শুরু হয় সংস্কার আন্দোলন। এই আন্দোলন শত দিবসের সংস্কার নামে পরিচিত।
- দ্বিতীয়ত : ১৯১৬ সালে সাই উয়ান-পেই পিকিং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হলে তাঁর নেতৃত্বে নতুন বৌদ্ধিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।
- তৃতীয়ত : অধ্যাপক চেন-তু-শিউ র প্রভাবে ছাত্ররা প্রাচীন কনফুসীয় মতবাদ ত্যাগ করে যুক্তিবাদ, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ প্রভৃতি আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ওঠে।
- চতুর্থত : হু শি, চেন-তু-সিউ প্রমুখ গণ আন্দোলনের চেতনা বৃদ্ধির জন্য 'পাই-হুয়া' বা কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনার সূচনা করেন। ফলে চিনা সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হয়। চিনা সাহিত্য প্রকৃতই জনগণের সাহিত্য হয়ে ওঠে।
- পঞ্চমত : চিনে এই সময় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে জাগরণ, জ্ঞানের আলো, নব তারুণ্য, নতুন জোয়ার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এইগুলি দেশবাসীকে নব মার্কসবাদ আধুনিকতা, ও বহু নতুন ভাবাদর্শে দীক্ষিত করে।
এইভাবে বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবে বৌদ্ধিক আন্দোলনের প্রসার ঘটলে দেশের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। যেমন হুনান প্রদেশে মাও-সে-তুং 'নতুন গণ অধ্যয়ন সমিতি' স্থাপন করেন। এদের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক কর্মকান্ডে চিনে এক ধরণের নবজাগরণ ঘটে যায়।
-------------------//--------------------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন