সার্ক কী? এর উদ্দেশ্য কী ছিল? গড়ে ওঠার পটভূমি আলোচনা করো। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণে কতটা সফল হয়েছিল? (২০১৬)
What is SAARC? What was its purpose? Discuss the background of its development. How successful was SAARC in meeting its goals and objectives?
সার্ক কী?
সার্ক (SAARC) হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ৮ই ডিসেম্বর। প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো হল ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ। পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্ত হয় আফগানিস্তান। পর্যবেক্ষক হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে চীন ও জাপানকে। এর সদর দপ্তর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু।
সার্কের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী ছিল?
সার্কের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ আলোচনা করা ও এ বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। সার্ক সনদের প্রথম ধারাতেই তা বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১) উন্নয়ন :
সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে অগ্রগতি ঘটানো।
২) আত্মনির্ভরতা :
প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা ও যৌথ উদ্যোগে আত্মনির্ভরতার শক্তি বৃদ্ধি করা।
৩) উৎসাহ প্রদান :
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সক্রিয় সহযোগিতায় উৎসাহ দান করা।
৪) তথ্যের আদান-প্রদান বৃদ্ধি :
পরস্পরের সহযোগিতায় দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতির লক্ষ্যে সদস্য দেশগুলির মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান বৃদ্ধি করা।
৫) জনকল্যাণে কাজ করা :
পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণ সাধন ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটানো।
৬) বোঝাপড়া বৃদ্ধি করা :
সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস বোঝাপড়া ও সাংবিধানশীলতার পরিবেশ তৈরি করা।
৭) সার্বভৌমত্ব রক্ষা :
সদস্য রাষ্ট্রগুলির ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষা করা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
৮) নিরাপত্তা বিধান করা :
প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা এবং সমস্ত রকম সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করা।
৯) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান :
সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা।
সার্ক গড়ে ওঠার কারণ বা পটভূমি :
সার্ক গড়ে ওঠার পিছনে একাধিক কারণ ছিল। এই কারণগুলো বিশ্লেষণ করলেই এর পটভূমি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি :
ক) মুজিব-হত্যাজনিত পরিস্থিতি :
১৯৭৫ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে সরিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। এই পরিস্থিতিতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন প্রতিবেশী দেশগুলির সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না।
জল বন্টন ও ভুমি সংক্রান্ত সমস্যা :
এছাড়া ভারতের সঙ্গে জল বন্টন ও ভূমি সংক্রান্ত একাধিক সমস্যার সমাধান করা দরকার ছিল। এ বিষয়ে ভারত ও নেপালসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। এই ভাবনা থেকেই জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগত চেষ্টায় ১৯৭৯ সালে সার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।
২) আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট :
ক) সিকিমের পরিস্থিতি :
১৯৭৫ সালে ভারত সরকার সিকিমকে ভারতভুক্ত করে নেয়। ফলে বাংলাদেশসহ ছোট ছোট প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি ভীত হয়ে পড়ে।
খ) বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা :
১৯৭৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ভারতে ইন্দ্রা গান্ধী পরাজিত হন, পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টুকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করেন, শ্রীলঙ্কায় শ্রীমতি বন্দর নায়কের সরকারকে উৎখাত করেন জে. আর. জয়বর্ধনে। বাংলাদেশ দু বছর আগেই (১৯৭৫) এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে এসব দেশের নতুন শাসকেরা নিজেদের প্রয়োজনেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হন।
গ) সত্তর দশকের অর্থনৈতিক সংকট :
১৯৭০ এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ১৯৭৯ সাল নাগাদ দ্বিতীয় তৈল সংকটের ফলে যা আরও গভীর হয়। আসিয়ান (ASEAN) জোটভুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি পারস্পরিক সহযোগিতা মাধ্যমে এই সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশ গুলিও এই ধরনের আঞ্চলিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
৩) আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট :
ক) গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন :
আলোচ্য সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে New International Economic Order 1974, Non Aligned Summit 1976, United Nations conference 1978 এবং 1979 সালে G-7 এর বৈঠক নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির সামগ্রিক আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য সার্বিক গাঁটছাড়া বাঁধার প্রয়োজন আছে।
খ) আফগানিস্তানে সোভিয়েত অনুপ্রবেশ :
এছাড়া ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সুসম্পর্কের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
৪) সার্ক প্রতিষ্ঠা :
উপরোক্ত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান জিয়াউর রহমানের ব্যবস্থাপনায় ঢাকা শহরে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ মিলিত হয়ে সার্ক গঠন করে।
সার্কের সাফল্য ও ব্যর্থতা :
বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সার্কের প্রতিষ্ঠা হলেও বহু ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ হয়েছে।
১) সার্কের সমস্যা বা ব্যর্থতার কারণ :
ক) রাজনৈতিক অস্থিরতা : দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ভারত-পাক বিরোধের কারণে বহু ক্ষেত্রেই লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
খ) ভারত শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের অবনতি : শ্রীলংকার তামিল জঙ্গিদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ঘটনায় শ্রীলংকা ভারতের মদন দেয়ার অভিযোগ তোলে। ফলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়।
গ) ভারসাম্যহীনতা : ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সামরিক ও আর্থিক শক্তির ব্যবধান থাকায় তাদের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
ঘ) মতপার্থক্য : সার্কের কর্মপদ্ধতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এই মতভেদ সার্কের সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
ঙ) সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ : তামিল জঙ্গি হানায় শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলা, বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মৌলবাদ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মধ্যে সদস্য দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ এই সংগঠনকে দুর্বল করেছে।
চ) পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাব : পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্য নিয়ে সার্ক গঠিত হলেও অনেক সময় সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পর্যাপ্ত সহযোগিতার মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না।
২) সার্কের সাফল্য :
সমস্যা থাকলেও সার্কের সাফল্যকে খাটো করে দেখা যায় না। নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সার্কের সাফল্য উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত : সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক আদান-প্রদান ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত : সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধেও মোটামুটি সন্তোষজনক সাফল্য এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়।
তৃতীয়ত : দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সার্ক বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে।
চতুর্থত : খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
পঞ্চমত : শিশু কন্যাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে স্যারভুক্ত দেশ গুলি পারস্পরিক সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
পরিশেষে, নেপালের রাজধানী কান্ড কাঠমান্ডুতে সার্কের স্থায়ী সচিবালায় প্রতিষ্ঠা করে সার্কের কর্মসূচি কে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সার্কের মূল্যায়ন :
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় সার্ক তার লক্ষ্য পূরণে সম্পূর্ণ সমর্থ্য না হলেও তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেনি। আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নে সার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
----------xx---------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন